শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ ও মুক্তমনার নিবেদন মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা)বেরুলো

ভাববাদী বনাম বস্তুবাদী যুক্তিবাদ

শহিদুল ইসলাম

 ...আজ অনেকেই বিশ্বাস করেন যে ডেমোক্রিটাস ও প্লেটোর মাধ্যমে বস্তুবাদী ও ভাববাদী দর্শনের শুরু। সে দ্বন্দ্বের আজও নিরসন হয় নি। বিজ্ঞান আজ আত্মা সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে ডেমোক্রিটাসের বস্তুবাদী দর্শন সমর্থন করে। দেহের মধ্যে ‘আত্মা’ নামের আলাদা কোন কিছুর অস্তিত্ব¡ আধুনিক বিজ্ঞান অস্বীকার করে। আত্মা দেহময়-বস্তুময়। বিজ্ঞান আজ প্রমাণ করেছে যে পৃথিবীতে একসময় কোনো জৈব পদার্থ ছিল না। দীর্ঘ ক্রমবিকাশের পথ ধরে রাসায়নিক ভাঙ্গা-গড়ার মধ্য দিয়ে একসময় অজৈব পদার্থ থেকে জৈব পদার্থের সৃষ্টি হয়। বিবর্তনের মাধ্যমে এককোষী প্রাণী থেকে বহুকোষী প্রাণীর আবির্ভাব এক অবিচ্ছিন্ন গতি। এভাবে আধুনিক বিজ্ঞান পরীক্ষা-নিরীক্ষার জটিল পথ ধরে ক্রমান্বয়ে প্রাণ সৃষ্টির দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। প্রমাণ হয়েছে, প্লেটো নয়, ডেমোক্রিটাসই যুক্তির সাহায্যে আত্মা সম্পর্কে সত্যের অনেক কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন। প্লেটোর ভাববাদী যুক্তি নয়, ডেমোক্রিটাসের বস্তুবাদী যুক্তিই বিজ্ঞানের জন্ম দিয়েছে। তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় আজকের বিজ্ঞানের জগতে প্লেটো নয়, ডেমোক্রিটাসই নায়ক।...


 

‘মুক্তান্বেষার’ প্রথম সংখ্যার কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে ‘যুক্তিবাদকে’ বেছে নেওয়া হয়েছে। কারণ মুক্তান্বেষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ‘যুক্তিবাদ’ প্রতিষ্ঠা। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমিও যুক্তিবাদী - যুক্তিকে খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকি। যুক্তির সাহায্যে যা গ্রহণযোগ্য মনে হয় তাই গ্রহণ করি, যুক্তি দিয়ে যাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারি না, তাকে গ্রহণ করতে পারি না। যুক্তির সাথে ‘প্রশ্ন’ যুক্ত থাকে। ‘প্রশ্নহীন’ যুক্তি হতে পারে না। সাধারণত ‘বিশ্বাসবাদের’ বিপরীত অর্থে ‘যুক্তিবাদ’ চিহ্নিত হয়ে থাকে। কিন্তু ‘বিশ্বাসের’ সাথে ‘যুক্তির’ সাপে-নেউলে সম্পর্ক। ‘বিশ্বাস’ প্রশ্নহীন। বিশ্বাসীদের কথা খুব সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে নিচের প্রবচনে :
‘বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।’


‘বিশ্বাসে বস্তু মেলায়’-এর কোনো প্রমাণ বা দৃষ্টান্ত উপস্থিত করতে পারেন নি কোন বিশ্বাসী। কিন্তু পৃথিবীর তাবৎ মানব সৃষ্ট বস্তু ভা-ার, আজ সারা পৃথিবীতে যার জয়-জয়কার, তা বিজ্ঞানের সৃষ্টি। ‘তর্ক’ হচ্ছে ‘যুক্তিবাদের’ অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। বিজ্ঞানের ভিত্তি হচ্ছে ‘যুক্তি’Ñবিশ্বাস নয়। কেবল ‘বিশ্বাসের’ ওপর নির্ভর করে মানুষ এককণা শস্য উৎপন্ন করতে পারে নি। ‘বিশ্বাস’ কেবল মানুষের মাঝে প্রাচীরের পর প্রাচীর তুলেছে - হানাহানি, খুনোখুনির পথ প্রশস্ত করেছে। কিন্তু ‘যুক্তি’ বিজ্ঞানের পথ প্রশস্ত করেছে। তাই যারা ‘যুক্তিবাদী’ তারাই সব সময় পৃথিবীর ওপর রাজত্ব করে এসেছে - এখনও করছে। আর যারা ‘বিশ্বাসবাদী’, তারা সমাজ-সভ্যতার নিচু তলায় পড়ে রয়েছে। তাই ‘মুক্তান্বেষার’ এই উদ্দেশ্য মহৎ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একটি যুক্তিবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠায় ‘মুক্তান্বেষা’ দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাবে, তা আমি বিশ্বাস করি।


তাই আজ আমরা একথা সবাই স্বীকার করি যে, ‘বিশ্বাসের’ বিপরীতে ‘যুক্তিবাদ’ একটি প্রগতিশীল প্রপঞ্চ। সমগ্র পৃথিবী যখন ‘বিশ্বাসীদের’ দখলে ছিল, তখন যিনি বা যারা প্রথম যুক্তির পথে হাঁটার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁরা একটি প্রগতিশীল কাজই করেছিলেন, যে ‘যুক্তিবাদ’ যতই দুর্বল হোক না কেন? আজ সবাই স্বীকার করেন আদি পর্বে গ্রিক প্রকৃতি দার্শনিকরা সে কাজটি করেছিলেন। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনও সে কথা স্বীকার করেন। বলেন ‘সর্বপ্রথম সেদিন সারা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে ‘যৌক্তিক’ পদ্ধতি বা ‘যুক্তির’ অলৌকিক শক্তি লক্ষ করেছিল। যুক্তির সাহায্যে ধাপে ধাপে মানুষ সে জ্ঞানের কত সূক্ষ্মতায় পৌঁছাতে পারে, সেদিন গ্রিক দার্শনিক ও প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা তা প্রমাণ করেছিলেন।”(১)


কিন্তু আমরা যখন ‘বিশ্বাসের জগত’ ছেড়ে ‘যুক্তির জগতে’ প্রবেশ করি, তখন যুক্তির সীমাবদ্ধতাগুলো প্রকাশ হয়ে পড়ে। সে বিষয়ে প্রতিটি যুক্তিবাদী মানুষের সতর্ক হওয়া দরকার। প্রশ্ন ওঠে “যুক্তির সাহায্যে কি আমরা শুধুই সত্যে পৌঁছাতে পারি? ভুল বা ভ্রান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি না?” ‘যুক্তি’ বা ‘চিন্তার’ সাহায্যে কি আমরা বস্তু জগতের প্রকৃত জ্ঞান লাভ করতে পারি? গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে বস্তুজগতের জ্ঞানার্জনে শুধু ‘যুক্তি’ আমাদের কোন সাহায্য করে না। তবে ‘বিশ্বাসবাদ’ দ্বারা যেমন বস্তুলাভ সম্ভব নয়, সম্ভব নয় বস্তুজগতের কোনো জ্ঞান লাভ; ‘যুক্তি’ তেমন নয়। ‘যুক্তি’ আমাদের সত্যের পথে অথবা ‘মিথ্যার’ পথেও টেনে নিয়ে যেতে পারে। সেদিক থেকে ‘খাঁটি বিশ্বাসবাদের’ চেয়ে ‘খাঁটি যুক্তিবাদ’ একটি উন্নত বা শ্রেষ্ঠতর প্রপঞ্চ। কেবল ‘যুক্তিবাদ’ যে বস্তুজগতের জ্ঞানার্জনে আমাদের কোনো সাহায্য করে না, সে কথার সমর্থনও আমরা পাই আইনস্টাইনের কাছে। তিনি বলছেন “
Pure logical knowledge cannot yield us any knowledge of the empirical world”(২) অর্থাৎ অভিজ্ঞতালব্ধ পৃথিবীর কোনো জ্ঞান যৌক্তিক জ্ঞানের মাধ্যমে পাওয়া যায় না। যুক্তির সঙ্গে ইন্দ্রিয়জ বা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের সংযোগই আমাদের ক্রমান্বয়ে সত্যের নিকটবর্তী করে। অর্থাৎ যুক্তির সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভা-ার যুক্ত না হলে বিজ্ঞানের জন্ম হয় না। আইনস্টাইনের মতে আধুনিক বিজ্ঞানের প্রসব লগ্নে কেপলার ও গ্যালিলিও সে কাজটি শুরু করেন। সমগ্র বস্তুসত্তার রহস্য উদ্ঘাটনে বিজ্ঞানের প্রয়োগের জন্য তাঁরা এক নতুন রাস্তা খুলে দেন। তাই আইনস্টাইন বলেন, “all knowledge of reality starts from experience and ends in it”।(৩)


এবার আমরা বিশ্বাসের জগত ছেড়ে যুক্তির জগতে প্রবেশ করবো। আমরা দেখবো, ‘যুক্তি’ বা ‘যৌক্তিক পদ্ধতি’ আমাদের যেমন বস্তুবাদী সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করে, তেমনিই তা চরম ভাববাদী সিদ্ধান্তেও আমাদের পৌঁছে দেয়। যে গ্রিক সভ্যতার দার্শনিক ও প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা ‘যুক্তির’ চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন, সেই গ্রিক সভ্যতা থেকেই কিছু উদাহরণের সাহায্যে একথার সত্যতা প্রমাণ করা যায়। প্রথমেই ‘আত্মার’ কথা ধরা যাক। পরমানুতত্ত্বের জনক ডেমোক্রিটাস (৪৬০-৩৭০ খ্রি:পূ) যুক্তির সাহায্যে প্রমাণ করেছিলেন যে আত্মা অবিনশ্বর নয় - নশ্বর। তিনি যুক্তি উত্থাপন করেছিলেন ‘আত্মা মানুষের জীবনীশক্তি। আত্মাই যে গতির উৎস এটা প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “যা গতিহীন তা অন্য কোনো বস্তুকে গতিশীল করতে পারে না। সুতরাং শরীরের গতির জন্য আত্মাকেও শরীরী (
corporeal) এবং গতিশীল হতে হবে।”(৪) ডেমোক্রিটাস মনে করতেন আত্মা গোলাকার পরমাণু দ্বারা গঠিত। আত্মা নশ্বর কারণ দেহের মৃত্যুর সাথে তারাও চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আত্মারও মৃত্যু ঘটে। কোনো রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ডেমোক্রিটাস আত্মার ওই বস্তুবাদী ধারণা লাভ করেন নি; করেছিলেন নির্ভেজাল যুক্তির মাধ্যমে।


অন্যদিকে সক্রেটিস যুক্তিবাদে অনন্য সাধারণ প্রতিভা প্লেটো (৪২৮/৪২৭-৩৪৭ খ্রি:পূ) যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন যে আত্মা অমর ও অবিনশ্বর। দেহের মৃত্যুর সাথে আত্মার মরণশীল দেহ পরিত্যাগ করে অমর জগতে প্রবেশ করে। প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ ও ‘ডায়লগগুচ্ছ’ যুক্তি-বিন্যাসের এক অপরূপ সৃষ্টি। ডায়লগ ‘ফিডোতে’ তিনি আত্মার ‘অমরত্ব’ ও ‘অবিনশ্বরতা’ কিভাবে প্রমাণ করেছিলেন, সেদিকে একবার দৃষ্টি দেওয়া যাক। সক্রেটিস ও সিবিসের আলাপচারিতায় সক্রেটিস বলছেন “তাহলে, এবার তুমি বল কিসের কারণে দেহ জীবিত হয়ে উঠবে’?


সে অবশ্যই আত্মা।


সব সময়ের জন্য কি একথা সত্য?


হ্যাঁ, সব সময়ের জন্যই সত্য


তাহলে আত্মার যা কিছু অধিকার, আত্মা তাতেই জীবন সঞ্চার করে?


অবশ্যই।


বেশ, জীবনের বিপরীত কিছু আছে কি?


হ্যাঁ, জীবনের বিপরীত নিশ্চয়ই আছে।


কে জীবনের বিপরীত?


জীবনের বিপরীত মৃত্যু।


কিন্তু আমাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুসারে আত্মা দেহের মধ্যে যা বহন করে আনে তার বিপরীতকে সে স্বীকার করে না।


সিবিস বললেন, আত্মার পক্ষে তার বিপরীতকে স্বীকার করা অসম্ভব।


কিছু পূর্বে আমরা একটা নীতির কথা উল্লেখ করেছি যার ফলে বুজাড়ও প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায়।’
কি সে নীতিটি?


সে হচ্ছে বেজোড়।


কিন্তু ন্যায় কিংবা সুরকে অস্বীকার করে কে?


অন্যায় এবং অ-সুর।


কিন্তু সে মৃত্যুকে অস্বীকার করে তাকে আমরা কি বলি?


তাকে বলি অমর।


বেশ, আত্মা কি মৃত্যুকে স্বীকার করে?


না, তা সে করে না।


তাহলে আত্মা অমর।


হ্যাঁ, আত্মা অমর।


তাহলে এবার আমরা বলতে পারি যে, ‘আত্মা অমর’ এ প্রতিপাদ্য প্রমাণিত হল।(৫) আত্মার অবিনশ্বরতার প্রমাণে সক্রেটিস বললেন, “... সকল মানুষই একথা স্বীকার করে যে পরম স্রষ্টা এবং জীবনের পরম সত্তা আর অমরতার কোন ধ্বংস নেই।” সিবিস বললে, ‘হ্যাঁ, শুধু সকল মানুষ নয়, আমি বলব স্বর্গের দেবতাগণও একথা স্বীকার করেন।’


কাজেই অমর যদি অবিনশ্বর হই, তাহলে আত্মা যখন অমর তখন আত্মাও কি অবিনশ্বর নয়?


অবশ্যই সে অবিনশ্বর।


তাহলে কি আমরা বলতে পারিনা যে, মৃত্যু যখন মানুষকে আক্রমণ করে তখন মানুষের নশ্বর অংশের মৃত্যু ঘটলেও তার অমর এবং অবিনশ্বর অংশের মৃত্যু ঘটে না, বরঞ্চ মৃত্যুর আগমনে সে দেহকে পরিত্যাগ করে অক্ষয় হয়ে বিরাজ করে?’ যথার্থই আমরা তা বলতে পরি।”(৬)


এভাবে ‘আত্মা’ সম্পর্কে ডেমোক্রিটাস ও প্লেটো সম্পূর্ণ যুক্তির মাধ্যমে দুই সম্পূর্ণ বিপরীতমুখি সিদ্ধান্তে পৌঁছেন।


‘ফিডো’ হচ্ছে প্লেটোর একটি বিখ্যাত ‘সংলাপ’। এই সংলাপে তিনি ডেমোক্রিটাসের নাম না করেই তাঁর পরমাণুতত্ত্বকে আক্রমণ ও খন্ডন করেছিলেন। শুধু তাই নয়। উক্ত সংলাপে প্লেটো এনাক্সোগোরাসের (৫০০-৪২৮ খ্রি:পূ) অসংলগ্ন বস্তুবাদকেও আক্রমণ করে মন বা ভাবের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছিলেন তাঁর ক্ষুরধার যুক্তির মাধ্যমে। এনাক্সোগোরাসও মনে করতে ‘মনই’ বস্তুজগতের প্রধান সত্তা। কিন্তু সে মন ‘বস্তু’ দ্বারা গঠিত। মন সম্পর্কে তাঁর এই বস্তুবাদী ব্যাখ্যা সে সময়ের শাসকশ্রেণী মেনে নিতে পারে নি। তাঁর এই মতের জন্য তিনি ‘নাস্তিকরূপে’ চিহ্নিত হয়েছিলেন। তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল। জীবন বাঁচাতে তিনি এথেন্স থেকে পালিয়েছিলেন।


‘ফিডো’ সংলাপটি ভালভাবে পড়লে জানা যায় যে প্লেটোর সময় ‘আত্মা’ সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাস ছিল ডেমোক্রিটাসের অনুরূপ। ‘আত্মা’ যে নশ্বর, এটাই ছিল চলতি বিশ্বাস। সিমিয়াদের কথায় তা পরিষ্কার হয়ে যায়। তর্কের এক পর্যায়ে তিনি বলছেন, “এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের মনে যে ধারণাটি রয়েছে, তাকে আমিও নিজের মন থেকে ভিত্তিহীন বলে দূর করে দিতে পারছিনে। সাধারণের মধ্যে এরূপ একটি ধারণা রয়েছে যে, মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার আত্মাও শূন্যে মিলিয়ে যায় এবং এই মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আত্মারও হয়তো অবলোপ ঘটে। এ ধারণাটি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া চলে না।”(৭) তখন সক্রেটিস বলেন, “আমি বুঝতে পারছি, তোমাদের মনে একটি শিশুসুলভ আশঙ্কা জেগে উঠেছে যে, আত্মা যখন দেহ পরিত্যাগ করে যায়, তখন তার যাত্রাপথে একটা দমকা হাওয়া কি তাকে ছিন্নভিন্ন করে চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে পারে না।”(৮) এটাই ডেমোক্রিটাসের তত্ত্ব। সাধারণ মানুষ তাঁর যুক্তিতেই বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। তার অনেক কারণ আছে। তবে প্রধান কারণ হচ্ছে এই যে মানুষ তার অভিজ্ঞতায় কখনও দেখেনি যে মৃত্যুর পর ‘অবিনশ্বর ও অমর’ আত্মা পুনরায় মৃত দেহের মধ্যে প্রবেশ করে তাকে জীবিত করে তুলছে। অথচ প্রাচীন সভ্যতায়, বিশেষ করে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় মানুষের তেমনই বিশ্বাস ছিল। তাই জীবিত হওয়ার আকাক্সক্ষায় নরপতিগণ দেহকে ‘মমি’ করে পিরামিড নামের কবরের মধ্যে রেখে দিত। কিন্তু কোনো মমি প্রাণ ফিরে পেয়েছে তেমন কোনো তথ্য প্লেটোর সময় সাধারণ মানুষ পায় নি। আজও পাওয়া যায় নি। কিন্তু প্লেটো ডেমোক্রিটাসের তত্ত্বকে আক্রমণ করে সেই অসত্য তত্ত্বকেই জীবনদান করেন। আত্মার অমরত্ব ও অবিনশ্বরতা এবং মৃত্যু পরবর্তী পৃথিবীর ভয় দেখিয়ে সেদিনের অমানবিক দাস প্রথার শ্রেণী শোষণকে জিইয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। সক্রেটিসের মুখ দিয়ে প্লেটো বলছেন, “আত্মা ও দেহ যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় তখন প্রকৃতির বিধান অনুযায়ী আত্মা শাসক এবং দেহ শাসিতের ভূমিকা গ্রহণ করে। তাই নয় কি? কিন্তু এই দুই ভূমিকার মধ্যে কোন ভূমিকাকে তুমি ঐশ্বরিক এবং কোনটিকে মানবিক বলবে? দুয়ের মধ্যে যে স্বাভাবিকভাবে হুকুম করে এবং শাসন করে তার ভূমিকাই অবশ্য তোমার নিকট অধিকতর ঐশ্বরিক এবং যে হুকুম শোনে এবং আজ্ঞা মানে তাকে অধিকতররূপে মানবিক বলে বোধ হবে?” অবশ্যই।


কিন্তু আত্মার সাদৃশ্য কার সাথে?


আত্মার সাদৃশ্য বিধাতার সঙ্গে আর দেহের সাদৃশ্য নশ্বরের সঙ্গে - এ সম্পর্কে আর সন্দেহ কি সক্রেটিস? তাহলে সিবিস, এবার চিন্তা করে দেখ, আমরা যা বলেছি তার সিদ্ধান্ত কি এই দাঁড়ায় না যে: আত্মা অবশ্যই ঐশ্বরিক, আত্মা অমর, সে বুদ্ধিমান এবং সঙ্গতিপূর্ণ, সে অ-দ্রাব্য এবং অপরিবর্তনীয়, অপরদিকে দেহ হচ্ছে মানবিক, সে মরণশীল এবং মূর্খ, সে বহুরূপী সে দ্রাব্য এবং পরিবর্তনীয়। প্রিয়, সিবিস, এ সিদ্ধান্তকে কি অস্বীকার করা যায়?
না, একে অস্বীকার করা যায় না।(৯)


প্লেটোর পরম ভাববাদী-দর্শনের স্বরূপ নিচের বক্তব্যে আরো পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে, “তোমার চক্ষু কর্ণ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়কে তুমি বিশ্বাস করিও না, তুমি ওদের মোহজাল থেকে বেরিয়ে এসো, নিজের জ্ঞানের জন্য ওদের ওপর নির্ভর করা থেকে তুমি নিবৃত্ত হও, কেননা, ওরা প্রতারক, তুমি নিজের পবিত্র সত্তার মধ্যে আত্মস্থ হও, নিজের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করিও, তোমার আপন বিশুদ্ধ উপলব্ধিই তোমার জ্ঞান, অন্য উপায়ে লব্ধ ভাবকে তুমি জ্ঞান বলে বিশ্বাস করো না - কেননা ওরা দৃশ্য, ওরা স্পর্শ্য আর তোমার আপন সত্তার উপলব্ধি অদৃশ্য, অস্পৃশ্য”(১০)।


ওপরের বক্তব্যে প্লেটোর জ্ঞানতাত্ত্বিক অবস্থান স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। জ্ঞান কোথা থেকে আসে? কিভাবে আসে? আমরা জ্ঞানার্জন করি কিভাবে? এখানে ডেমোক্রিটাসের জ্ঞানতাত্ত্বিক অবস্থান কি একটু ঘেঁটে দেখা যেতে পারে। ডেমোক্রিটাসের জ্ঞানতত্ত্ব অনুযায়ী আমরা দু’ভাবে জ্ঞান অর্জন করি। এক, আমাদের ইন্দ্রিয়ের দ্বারা, দুই, বুদ্ধি দ্বারা। ডেমোক্রিটাস ইন্দ্রিয়ের স্বাক্ষ্যকে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তাঁর মতো ইন্দ্রিয়ানুভূতিলব্ধ অভিজ্ঞতা হলো যুক্তিবাদী চিন্তার অবলম্বন। তাঁর মতে ইন্দ্রিয়ানুভূতি ছাড়া যুক্তিবাদী জ্ঞান লাভ অসম্ভব।
rational cognition is impossible without sensory experience.”(১১) প্লেটোয় জ্ঞানতাত্ত্বিক অবস্থান আরো স্পষ্ট হয় নিচের সংলাপে : সক্রেটিস বলছেন,


তাহলে তুমি বলতে চাচ্ছ যে, সব মানুষের পক্ষেই আমাদের আলোচিত বিষয়সমূহকে জানা কিংবা তার জ্ঞান রাখা সম্ভব নয়?


না, তা সম্ভব নয়। (সিমিয়াস বলছেন)


অর্থাৎ তাদের পক্ষে যা সম্ভব সে হচ্ছে, যে জ্ঞান তারা ইতিপূর্বে লাভ করেছে তাকেই ক্রমান্বয়ে স্মরণ করা?
হ্যাঁ, তাই।


কিন্তু আমাদের মন এই জ্ঞানকে কখন অর্জন করেছে? নিশ্চয়ই আমরা মানুষ রূপে জন্মগ্রহণ করার পরে না।
না, আমাদের জন্ম গ্রহণের পরে নয়।


তার মানে জন্মের পূর্বে এই জ্ঞানকে সে অর্জন করেছে?


অবশ্যই তাই।


সিমিয়াস, তাই যদি হয় তাহলে আমাদের সিদ্ধান্ত করতে হয় যে, আমাদের আত্মা মানুষের মধ্যে দেহ ধারণ করার পূর্বেও অস্তিত্বময় ছিল এবং দেহহীন সে অবস্থাতে সে জ্ঞানপূর্ণও ছিল।”(১২)


এভাবে প্লেটো যুক্তির সাহয্যে প্রমাণ করেন যে আমাদের জন্মের পূর্বে আত্মা জ্ঞানার্জন করে এবং সেই জ্ঞান ভা-ার নিয়ে আমাদের দেহে প্রবেশ করে।


আজ অনেকেই বিশ্বাস করেন যে ডেমোক্রিটাস ও প্লেটোর মাধ্যমে বস্তুবাদী ও ভাববাদী দর্শনের শুরু। সে দ্বন্দ্বের আজও নিরসন হয় নি। বিজ্ঞান আজ আত্মা সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে ডেমোক্রিটাসের বস্তুবাদী দর্শন সমর্থন করে। দেহের মধ্যে ‘আত্মা’ নামের আলাদা কোন কিছুর অস্তিত্ব¡ আধুনিক বিজ্ঞান অস্বীকার করে। আত্মা দেহময়-বস্তুময়। বিজ্ঞান আজ প্রমাণ করেছে যে পৃথিবীতে একসময় কোনো জৈব পদার্থ ছিল না। দীর্ঘ ক্রমবিকাশের পথ ধরে রাসায়নিক ভাঙ্গা-গড়ার মধ্য দিয়ে একসময় অজৈব পদার্থ থেকে জৈব পদার্থের সৃষ্টি হয়। বিবর্তনের মাধ্যমে এককোষী প্রাণী থেকে বহুকোষী প্রাণীর আবির্ভাব এক অবিচ্ছিন্ন গতি। এভাবে আধুনিক বিজ্ঞান পরীক্ষা-নিরীক্ষার জটিল পথ ধরে ক্রমান্বয়ে প্রাণ সৃষ্টির দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। প্রমাণ হয়েছে, প্লেটো নয়, ডেমোক্রিটাসই যুক্তির সাহায্যে আত্মা সম্পর্কে সত্যের অনেক কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন। প্লেটোর ভাববাদী যুক্তি নয়, ডেমোক্রিটাসের বস্তুবাদী যুক্তিই বিজ্ঞানের জন্ম দিয়েছে। তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় আজকের বিজ্ঞানের জগতে প্লেটো নয়, ডেমোক্রিটাসই নায়ক।


কিন্তু আজকের বিশ্বে, বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির যুগেও, প্লেটোর ভাববাদী ‘আত্মায়’ বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা কম নয়। কারণ প্লেটোর দর্শন ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে অনেকটা সঙ্গতিপূর্ণ। ডেমোক্রিটাসের দর্শন নয়। তাই আমরা প্লেটোকে যতটা গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক হিসেবে স্বীকার করি, ঠিক ততটাই ডেমোক্রিটাস অবহেলিত। অথচ আধুনিক বিজ্ঞান ডেমোক্রিটাসের জয় ঘোষণা করেছে। আইনস্টাইন তাঁর উত্তরসূরি। তাই বলছিলাম, ‘যুক্তি’, কেবলই ‘যুক্তি’ আমাদের যেমন সত্যের কাছাকাছি নিতে সাহায্য করে, তেমনই তা আমাদের সত্যের হাজার মাইল দূরেও ঠেলে দিতে পারে। ‘যুক্তিবাদ’ নিয়ে কাজ করার সময় একথাটি মনে রাখা দরকার।


তবে, ডেমোক্রিটাস ও প্লেটোর যুগ আজ আর নেই। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথ ধরে বিজ্ঞান আজ অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছে। আজকের ‘যুক্তিবাদের’ পিছনে বিজ্ঞানের শক্ত এক সমর্থন রয়েছে। বিজ্ঞান আজ য্ুিক্তবাদের বস্তুবাদী ধারাকে করে তুলেছে অনেকটা শক্তিশালী। অপরদিকে ভাববাদী যুক্তিবাদকে করেছে দুর্বল। তবুও এতো মিথ্যা নয় যে ধর্ম ও শ্রেণী বিভক্ত সমাজ ভাববাদী যুক্তিবাদকে আজও ধারণ করে আছে।
 

তথ্যসূত্র:
১। শহিদুল ইসলাম “আইনস্টাইনের দর্শন ও দৃষ্টবাদ”: বিশেষ সংখ্যা বিশ্ব পদার্থবিদ্যা বছর ২০০৫, শিক্ষাবার্তা, অক্টোবর ২০০৫, পৃষ্ঠা: ৪৮।
২।
Albert Einstein “The World as I see It’ - Covici Friede Publishers, New York, 1934 Page 31-33)
৩। ঐ, পৃষ্ঠা ৩১-৩৩
৪। শহিদুল ইসলাম বিজ্ঞানের দর্শন: দ্বিতীয় খ-: শিক্ষাবার্তা প্রকাশনা, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা ২২২।
৫। সরদার ফজলুল করিম, ‘প্লেটোর সংলাপ’ বাংলা একাডেমি, ঢাকা ,প্রথম পুনর্মুদ্রণ: মাঘ ১৩৯৯/জানুয়ারি ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১২৭-১২৮।
৬। ঐ, পৃষ্ঠা ১২৯-১৩০
৭। ঐ, পৃষ্ঠা ৮৭
৮। ঐ, পৃষ্ঠা ৮৮
৯। ঐ, পৃষ্ঠা ৯১-৯২
১০। ঐ, পৃষ্ঠা ৯৬
১১।
A.S. Bogomolou History of Ancient Philosophy, Progress Publishers, Moscow 1985, Page 161-162
১২। সরদার ফজলুল করিম, ‘প্রাগুক্ত’, পৃষ্ঠা ৮৬

 


মুক্তমনের মানুষ ও সেক্যুলারিস্ট অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম প্রাবন্ধিক হিসেবে সুপরিচিত। শিক্ষা, বিজ্ঞান দর্শন তাঁর লেখার প্রিয় বিষয়। ফলিত রসায়ন ও রাসায়নিক প্রযুক্তির অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নব প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের তিনি ছিলেন প্রথম পরিচালক। সমাজ ও রাজনীতি সচেতন এই শিক্ষাবিদ শিক্ষা ও শিক্ষক সম্বন্ধীয় সমস্যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনের সাথে জড়িত। শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের অন্যতম সহ সভাপতি। দুটি খন্ডে সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থটির নাম ‘বিজ্ঞানের দর্শন’। তাঁর কয়েকটি পরিচিত গ্রন্থ হল: সাম্প্রদায়িকতা রাষ্ট্র রাজনীতি, জাতীয়তাবাদ : সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, প্রসঙ্গ : শিক্ষা, দেশভাগ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় .. । 

 


 

মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা):  যোগাযোগ – সাইফুর রহমান তপন, ৬/৭, সেগুনবাগিচা; বি/৬, ডোমিনো এল্ডোরাডো, ঢাকা – ১০০০, টেলিফোনঃ ৬৬৬৮৬৪০৪৭১, ইমেইলঃ tapan@spb.org.bd, অথবা, muktanwesa@yahoo.com  

অথবা,

ঋত্বিক, ৩৪ আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা ১০০০