বিবর্তনের আর্কাইভ
ভ্রান্ত ধারণা
জাকির নায়েক তার বক্তৃতায় প্রমাণ করেছেন যে বিবর্তন ভুল
১) বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ইসলামী পণ্ডিত জাকির নায়েকের বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে সাত মিনিটের লেকচারটি মুসলিমদের খুবই প্রিয়। সাত মিনিটে অন্ততঃ ২৮ টি মিথ্যা বা ভুল কথার মাধ্যমে জাকির নায়েক ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব ভুল প্রমান করতে না পারলেও তার মতো সৃষ্টিবাদীরা কতটা অজ্ঞ তা ঠিকই প্রমান করেছেন। [1]।
জাকির নায়েকের বক্তৃতায় ভুল আসলে অসংখ্য, তার মধ্যে কয়েকটি হল [2] -
ক) জাকির নায়েক বলেছেন ডারউইন নাকি বীগল জাহাজে করে Calotropis দ্বীপে গিয়েছিলেন। কিন্তু Calotropis নামে পৃথিবীতে কোন দ্বীপ নেই, উদ্ভিদের একটা গণের (genus) নাম calotropis। ডারউইন গিয়েছিলেন “গালাপাগোস” দ্বীপে।
খ) “পেক অ্যাট নিচেস” এর কথা বলেছেন যার কোন অর্থ নেই। pecking এর বদলে living হবে।
গ) একে তো উনি দ্বীপ এবং পাখির নাম কোনটাই বলতে পারেননি, তার উপর পর্যবেক্ষণ করা পাখিগুলোকে একই প্রজাতির বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ঘ) জাকির নায়েক বলেছেন ডারউইন নাকি THOMAS THOMTAN নামে তার এক বন্ধুকে চিঠি লিখেছিলেন এই বলে যে তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচনে বিশ্বাস করেন না। অথচ এই নামে ডারউইনের কোন বন্ধু কখনোই ছিলো না।
ঙ) জাকির নায়েক বলেছেন, "ডারউইনের সময় মিসিং লিঙ্ক পাওয়া যায়নি। সেজন্য বিবর্তন ভুল"। একে তো মিসিং লিঙ্ক শব্দটাই অবৈজ্ঞানিক, তার উপর জাকিরের দাবীটিও সম্পূর্ণ অসত্য। আর্কিওপ্টেরিক্স (ডায়নোসার এবং পাখির মধ্যবর্তী ফসিল) সহ বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যবর্তী ফসিল তখনই পাওয়া গিয়েছিলো, 'অরিজিন অব স্পিশিজ' প্রকাশিত হবার দুই বছরের মধ্যেই। এছাড়া ডারউইন ভবিষ্যতে আরো এমন ট্রাঞ্জিশনাল ফসিল পাওয়া যাবে বলে বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যা পরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিলো।
চ) জাকির নায়েক তার বক্তৃতায় দাবী করেছিলেন গ্যালিলিওকে নাকি চার্চ মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলো। এটি ভুল। মূলতঃ ১৬৩৩ সালের ২২শে জুন গ্যালিলিওকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে তাকে শুধু গৃহবন্দী রাখা হয়। এরও অনেক পরে ১৬৪২ সালের ৮ই জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। গ্যালিলিওকে নয়, বরং জিওর্দানো ব্রুনোকে চার্চের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছিলো মৃত্যুদণ্ড।
ছ) জাকির নায়েক চারটি হোমোনাইট এর কথা বক্তৃতায় বলেছেন। হোমোনাইট বলে কিছু নেই। প্রকৃত শব্দটি হবে হোমিনিড (hominid); এবং এর সংখ্যা চারটি নয়, চোদ্দটি।
জ) ‘লুসি’কে অভিহিত করেছেন DOSNOPYTICHEST হিসেবে। এ নামে কোন হোমিনিড নেই। লুসি যে হোমিনিডের অন্তর্ভুক্ত তার নাম “Australopithecus afarensis”।
ঝ) তিনি বলেছেন, মানুষের বিবর্তনের নাকি চারটি ধাপের কথা বলা হয়। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। বিবর্তনের কোন টেক্সটেই চার ধাপের উল্লেখ নেই।
ঞ) জাকির বলেছেন ‘আইস এজ’ নাকি তিন মিলিয়ন বছর আগে ঘটেছিল। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, বরফ যুগ মোটেই সাড়ে তিন মিলিয়ন বছর আগের ঘটনা না। ১.৬ মিলিয়ন বছর পূর্ব থেকে শুরু করে এই ১০,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত বরফ যুগ ছিল।
ট) জাকির বলেছেন, হোমো স্যাপিয়েন্স নাকি ৫০০ হাজার বছর আগে মারা গেছে। জাকির জানেন না যে আমাদেরকেই মানে আধুনিক মানুষকেই হোমো স্যাপিয়েন্স ডাকা হয়, আর আমরা এখনও বহাল তবিয়তে বেচে আছি।
ঠ) তিনি P. P. GRASSE-র উল্লেখ করতে গিয়ে নায়েক SOJERION UNIVERSITY এর উল্লেখ করেছেন। প্যারিসে SOJERION UNIVERSITY নামে কিছু নেই, সমগ্র বিশ্বের কোথাও এই নামের কোন বিশ্ববিদ্যালয় নেই। তিনি সম্ভবত বলতে চেয়েছিলেন “University of Paris” এর কথা যাকে অনেক সময় “La Sorbonne” নামে ডাকা হয়। ইত্যাদি ...
এ ধরনের অসংখ্য ভুল এবং মিথ্যাচারে সমৃদ্ধ তার বিবর্তন বিষয়ে লেকচার। অসংখ্য ভুলের মধ্যে ২৮টি তালিকা করেছেন শিক্ষানবিস (খান মুহম্মদ), সেটি রাখা আছে এখানে । মাত্র মিনিট খানেকের বক্তৃতায় করা তার ভুলের সুদীর্ঘ তালিকা থেকে বোঝা যায় - জাকির নায়েক বিবর্তন সম্পর্কে সম্পুর্ণ অজ্ঞ। তাই তার বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি বিবর্তনকে ভুল প্রমাণ করতে পারেননি, বরং নিজেই হাস্যাস্পদ হয়েছেন।
এছাড়া ইউটিউবেও সম্প্রতি জাকির নায়েকের ভুলগুলো নিয়ে একটি ভিডিও তৈরি করা হয়েছে। তবে ভিডিওতে গ্যালিলিওকে যেভাবে ‘ডিভোটেড ক্যাথলিক’ বানানো হয়েছে তা রীতিমত হাস্যকর, আর ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা কথা তো পুরোপুরি চেপে যাওয়া হয়েছে (দেখুন - বিজ্ঞান ও ধর্ম সাংঘর্ষিক নয় বরং একে অপরের পরিপূরক -এই দাবীর উত্তর)। গ্যালিলিও এবং তার পূর্ববর্তী নিয়ে ওই খ্রীস্টিয় প্রোপাগাণ্ডার অংশটুকু বাদ দিলে বিবর্তনের অংশগুলোয় জাকির নায়েকের অজ্ঞতা পরিস্কারভাবে তুলে ধরে -
মুক্তমনায় প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ :
- জাকির নায়েকের মিথ্যাচার: প্রসঙ্গ ‘বিবর্তন’ : শিক্ষানবিস (খান মুহম্মদ)
- বিজ্ঞান ও ধর্ম সাংঘর্ষিক নয় বরং একে অপরের পরিপূরক -এই দাবীর উত্তর
[1] অভিজিৎ রায় এবং রায়হান আবীর, অবিশ্বাসের দর্শন, শুদ্ধস্বর, ২০১১
[2] শিক্ষানবিস (খান মুহম্মদ), জাকির নায়েকের মিথ্যাচার: প্রসঙ্গ ‘বিবর্তন’, মুক্তমনা; যুক্তি সংখ্যা ৩, জানুয়ারী ২০১০