বিবর্তনের আর্কাইভ
ভ্রান্ত ধারণা
বিবর্তনবাদ সামাজিক ডারউইনবাদ বা সোশাল ডারউইনিজম প্রমোট করে
ডারউইন বর্ণিত প্রাকৃতিক নির্বাচন আর সামাজিক ডারউইনিজম এক কথা নয়। ভিক্টোরিয়ান যুগে সামাজিক ডারউইনবাদের (social Darwinism) উদ্ভব ঘটান হার্বার্ট স্পেনসার নামের এক দার্শনিক, যা ডারউইন প্রদত্ত্ব বিবর্তন তত্ত্ব থেকে একেবারেই আলাদা। স্পেন্সর ডারউইন কথিত জীবন সংগ্রাম (struggle for life) কে বিকৃত করে ‘যোগ্যতমের বিজয়’ (survival of fittest) শব্দগুচ্ছ সামাজিক জীবনে ব্যবহার করে বিবর্তনে একটি অপলাপমূলক ধারণার আমদানী করেন। স্পেনসারের দর্শনের মূল নির্যাসটি ছিল - ‘might is right’। তিনি প্রচারণা চালান যে, গরীবদের উপর ধনীদের নিরন্তর শোষণ কিংবা শক্তিহীনদের উপর শক্তিমানদের দর্প এগুলো নিতান্তই প্রাকৃতিক ব্যাপার। প্রাকৃতিকভাবে বিবর্তনের ফলশ্রুতিতেই এগুলো ঘটছে, তাই এগুলোর সামাজিক প্রয়োগও যৌক্তিক। এ ধরনের বিভ্রান্তকারী দর্শনের ফলশ্রুতিতেই পরবর্তীতে বিভিন্ন শাষকগোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে ঔপনিবেশিকতাবাদ, জাতিভেদ, বর্ণবৈষম্যকে বৈধতা দান করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন বিভিন্ন সময়। হিটলার তার নাৎসীবাদের সমর্থনে একে ব্যবহার করেন। ১৯৩০ সালে আমেরিকার ২৪ টি রাষ্ট্রে ‘বন্ধ্যাকরণ আইন’ পাশ করা হয়, উদ্দেশ্য ছিল জনপুঞ্জে ‘অনাকাঙ্খিত’ এবং ‘অনুপযুক্ত’ দুর্বল পিতামাতার জিনের অনুপ্রবেশ বন্ধ করা। অর্থাৎ ‘সামাজিকভাবে ডারউইনবাদের প্রয়োগ’-এর মাধ্যমে ‘যোগ্যতমের বিজয়’ নানা ধরণের নৈরাজ্যজনক প্রতিক্রিয়শীলতার জন্ম দিয়েছিল, আর বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল, যা থেকে অনেকে এখনও মুক্তি পায় নি। কিন্তু সত্যি বলতে কি- ডারউইন কখনওই প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বকে কখনই সামাজিকজীবনে প্রয়োগ করার কথা ভাবেননি। কাজেই এ ধরনের বর্ণবাদী তত্ত্বের সাথে ডারউইন বা তার তত্ত্বকে জড়ানো নিতান্তই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
প্রকৃতিতে কিছু ঘটে বলেই তা সামাজিক জীবনেও প্রয়োগ করা উচিৎ - এ ধরণের চিন্তাধারা এক ধরনের কুযুক্তি বা হেত্বাভাস (fallacy)। হেত্বাভাসটির পুঁথিগত নাম হল - ‘প্রকৃতির দোহাই’ (Naturalistic fallacy)। প্রাকৃতিক নির্বাচন আসলে প্রকৃতিতে প্রজাতির প্রতিযোগিতার মাধ্যমে টিকে থাকার কিংবা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথাই শুধু ব্যাখা করছে - সামাজিক জীবনে এর প্রয়োগের ‘ঔচিত্য’ নিয়ে কখনোই মাথা ঘামাচ্ছে না। প্রকৃতিতে কিছু ঘটার অর্থ এই নয় যে তা সামাজিকভাবেও প্রয়োগ করতে হবে। আর তা ছাড়া বিবর্তনবাদের মুল বিষয়বস্তু ভালো করে বুঝলে দেখা যায় যে এর সাথে স্পেনসারের দেওয়া মতবাদের কোন সম্পর্কই নেই। প্রকৃতিতে কেবল নিরন্তর প্রতিযোগিতাই চলছে না, বরং বিভিন্ন ধরণের পারষ্রিক সহযোগিতা, মিথোজীবীতা কিংবা সহ-বিবর্তনও বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। জীবের টিকে থাকার জন্য এগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অথচ, সামাজিক বিবর্তনবাদে এই ব্যাপারগুলো অস্বীকার করে কেবল ‘যোগ্যতমের বিজয়’-এর কথাই কেবল সোচ্চারে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল, বিবর্তন ঘটার জন্য প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধরণের প্রকারণ অবশ্য প্রয়োজনীয়। জনপুঞ্জে জেনেটিক প্রকারণ না থাকলে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া কাজই করতে পারবে না। কিন্তু সামাজিক ডারউইনবাদের প্রবক্তারা জোর করে ‘অনাকাঙ্খিত’ জিনকে হটিয়ে দিয়ে প্রকারণকে দূর করার জন্য তৎপর হয়েছিলেন। এ জন্য বহু আগেই ‘সামাজিক ডারউইনবাদ’ সচেতন বৈজ্ঞানিক মহাল থেকে পরিত্যক্ত হয়েছে। অনেকেই অজ্ঞতার কারণে এখনো ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাথে পরিত্যক্ত সামাজিক বিবর্তনবাদকে গুলিয়ে ফেলেন।[1]
কাজেই সারসংক্ষেপ করলে দাঁড়ায়[2] -
১) এই কুযুক্তি ন্যাচারালিস্টিক ফ্যালাসির উদাহরণ। প্রকৃতিতে কিভাবে প্রজাতির উদ্ভব আর বিকাশ ঘটছে তা বিবর্তন তত্ত্ব স্বার্থকভাবে ব্যাখ্যা করে, কিন্তু মানব জীবনে সামাজিকভাবে প্রয়োগের ঔচিত্য নিয়ে মাথা ঘামায় না।
২) সোশাল ডারউইনিজমের জন্ম হয়েছে হার্বার্ট স্পেন্সরের হাতে। স্পেন্সরের চিন্তাধারা মূলতঃ ছিলো ল্যামার্কিয়ান এবং প্রটোস্ট্যাণ্ট নন-কনফর্মিটিজমের সাথে অধিকতর সম্পর্কিত। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের সাথে এর কোন যোগ ছিলো না।
৩) বিবর্তনবাদের মুল বিষয়বস্তু ভালো করে বুঝলে দেখা যায় যে এর সাথে স্পেনসারের দেওয়া মতবাদের কোন সম্পর্কই নেই। প্রকৃতিতে কেবল নিরন্তর প্রতিযোগিতাই চলছে না, বরং বিভিন্ন ধরণের পারষ্রিক সহযোগিতা, মিথোজীবীতা কিংবা সহ-বিবর্তনও বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়।
৪) বিবর্তন ঘটার জন্য প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধরণের প্রকারণ অবশ্য প্রয়োজনীয়। জনপুঞ্জে জেনেটিক প্রকারণ না থাকলে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া কাজই করতে পারবে না। কিন্তু সামাজিক ডারউইনবাদের প্রবক্তারা জোর করে ‘অনাকাঙ্খিত’ জিনকে হটিয়ে দিয়ে প্রকারণকে দূর করার জন্য তৎপর হয়েছিলেন।
৫) সামাজিক ডারউইনবাদ ভুল রাজনৈতিক মতাদর্শ কেন্দ্রিক ধারণা এবং সামাজিক প্রয়োগের সাথে সম্পর্কিত, বিবর্তনতত্ত্বের সাথে নয়।
মুক্তমনায় প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ :
বন্যা আহমেদ, আমাদের গল্প, বিবর্তনের পথ ধরে, অবসর, ২০০৭; মুক্তমনা।
দিগন্ত সরকার, ডারউইন থেকে ডাবল হেলিক্স , মুক্তমনা।
আরো পড়ুন -
Wilkins, John, 1997. Evolution and philosophy: Does evolution make might right?
Bannister, R. C., 1979. Social Darwinism: Science and Myth in Anglo-American Social Thought. Philadelphia: Temple University Press.
Bowler, P. J., 1993. Biology and Social Thought, 1850-1914. Berkeley papers in history of science; 15. Berkeley, Calif., Office for History of Science and Technology University of California at Berkeley: 95.
Hofstadter, R., 1944. Social Darwinism in American Thought. Philadelphia: University of Pennsylvania Press.
Kevles, D., 1995. In the Name of Eugenics: Genetics and the Uses of Human Heredity. New York: Knopf.
Ruse, Michael, 2001. Social Darwinism. Chapter 10 in: Can a Darwinian Be a Christian?, Cambridge University Press.
Singer, P., 2000. A Darwinian Left: Politics, Evolution, and Cooperation. New Haven: Yale University Press.