বাংলা ব্লগ

বিবর্তনের আর্কাইভ

বিবর্তন ব্লগ

মুক্তমনা কি?

প্রজেক্ট

ইবই

সাহায্য


  ভ্রান্ত ধারণা

আল্লাহ সব কিছু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন।

 

কোরানের কিছু আয়াত (৪৩:১২, ৫৩:৪৫, ১৩:৩ প্রভৃতি)  উদ্ধৃত করে অনেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে দৃশ্যমান জগতের সবকিছু ‘জোড়ায় জোড়ায়’ সৃষ্টি করা হয়েছে। 

 

দাবীটি ভ্রান্ত।

 

১) যারা এই দাবী করেন তারা নিজেদের ধর্মগ্রন্থ বিশ্লেষণ করলেই দেখবেন  সবকিছু জোড়ায় জোড়ায় তো সৃষ্টি হয়ইনি, উপরন্তু সৃষ্টিকর্তাকেও ‘এক এবং অদ্বিতীয়’ হিসেবে  বর্ণনা করা হয়েছে ধর্মগ্রন্থে।  আল্লাহর রসুল এবং শেষ নবীর মর্যাদাও পেয়েছেন একজনই। ইবলিসের মত শয়তান বানিয়েছেন তিনি একজনকেই।  আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব একটি, চন্দ্র একটি, সূর্য একটি, আমাদের দেহে নাক একটি, জিহ্বা একটি, পাকস্থলী একটি অগ্ন্যাশয় একটি ইত্যাদি।   

 

২) অনেকে বলেন ‘সবকিছু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি হয়েছে’ – আল্লাহর এই দাবীটি কেবল জীবজগতের জন্য প্রযোজ্য।  দাবীটি যদি সামগ্রিকভাবে জীবজগতের জন্যও করা হয় তাহলেও এটি ভুল। প্রাণীজগতের একেবারে প্রাথমিক দিকের কিছু পর্ব হলো - প্রটোজোয়া, পরিফেরা, সিলেনটেরেটা, প্লাটিহেলমিনথিস, অ্যানিলিডা, মোলাস্কা ও কর্ডাটাএই সমস্ত প্রাণীদের বেশিরভাগই উভলিঙ্গ বা হার্মাফ্রোডাইট (Hermaphrodite), কারণ এদের শরীরে স্ত্রী ও পুরুষ-জননাঙ্গের সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়এদের জন্য উভলিঙ্গত্ব কোনো শারীরিক ত্রুটি নয়, বরং এটি পুরোপুরি প্রাকৃতিকএরা এদের উভলিঙ্গত্ব নিয়েই স্বাভাবিক বংশবিস্তারে সক্ষম[1]।  

 

৩) আমাদের অতি পরিচিত প্রাণী কেঁচো উভলিঙ্গ[2]। সেটা কেঁচোর বংশবিস্তারে কোন সমস্যা করছে না। এছাড়াও ব্যানানা স্লাগ, হ্যামলেট এবং বহু-ধরণের স্মেইল উভলিঙ্গ-জীব হিসেবে প্রকৃতিতে টিকে আছে।[3]

 

৪) বহু প্রাণী আবার জোড়া ছাড়াই বংশবিস্তারে সক্ষম। যেমন, হুইপটেল গিরগিটি। এই  হুইপটেল গিরগিটিকুলের সবাই মহিলা, তাদের কোনো পুরুষ শয্যা-সঙ্গীর দরকার নেই[4]। পুরুষেরা তাদের জন্য বাহুল্য মাত্র।  এক ধরনের প্রাকৃতিক ক্লোনিংএর মাধ্যমে এদের দেহের  অভ্যন্তরে নিষেক ঘটে চলে অবিরত।  ফলে কোনো রকম শুক্রাণুর সংযোগ ছাড়াই দেহের ডিপ্লয়েড ডিম্বাণুর নিষেক ঘটে চলে।  জীববিজ্ঞানে এই প্রক্রিয়াকে বলে পার্থেনোজেনেসিস (Parthenogenesis)।  সম্ভবত মহান আল্লাহতালা সুরা নাজিলের সময় জীববিজ্ঞানের খুব সাধারণ এই প্রক্রিয়া সম্বন্ধে অবগত ছিলেন না।  

 

৫) ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট, ফাঙ্গাস, টেপওয়ার্ম সহ বহু জীব আছে যারা অযৌনপ্রজ বা Asexual. এদের জন্য জোড়া তৈরি কোন কাজে আসে না, আসেনি।  এরা ভালভাবেই প্রকৃতিতে টিকে আছে।

 

৬) মানব সমাজের দিকে তাকানো যাক। সবকিছু জোড়ায় জোড়ায় তৈরি হলে উভলিঙ্গ মানব(হিজড়া) বলে কিছু আমরা সমাজে দেখতাম না।  ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, প্রাচীন গ্রীসের সমকামিতা, প্রাচীন রোমে খোজা প্রহরী (Eunuch), নেটিভ ইন্ডিয়ানদের মধ্যে দ্বৈত সত্তা’, আরব ও পার্সিয়ায় বার্দাশএবং ভারতবর্ষে হিজড়াদের অস্তিত্ব  ‘সবকিছু জোড়ায় জোড়ায় তৈরি হয়েছে’ এই তত্ত্বকে বাতিল করে দেয়। এ ছাড়া আছে ভারতের কোতি, ওমানের জানিথ, ইন্দোনেশিয়ার লুডরুক বান্টুট, মাসরি এবং রায়গ, মালয়শিয়ায় আহকুয়া, বাপুক, পোনদান কিংবা নাকনিয়া। তুরস্কে নসঙ্গা, মুস্তাক্‌নে, আরবের মুখান্নাথুননেপালের মেটি, থাইল্যান্ডের কাথোই, চিনের তাংঝি, মালাগাসির তসিকাত্‌, মিশরের খাওয়াল, অ্যাঙ্গোলার চিবাদোস্‌, কেনিয়ার ওয়াসোগা, পর্তুগালের জিম্বাদা, পলিনেশিয়ার ফাফাফিনি, মেক্সিকোর জোতো/পুতোব্রাজিল এবং ইসরায়েলের ত্রাভেস্তি এবং ত্রান্সফরমিস্তা সহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে থাকা রূপান্তরকামী কিংবা উভলিঙ্গ সত্তা।


 

[1] অভিজি রায়, সমকামিতা : একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান, শুদ্ধস্বর, ২০১০

[4] জীববিজ্ঞানী জোয়ান রাফগার্ডেন তাঁর ইভলুশন রেইনবো’ (২০০৪) বইয়ে  হুইপটেল গিরগিটিদের লেসবিয়ান লিজার্ডহিসেবে উল্লেখ করেছেন।

প্রশ্নোত্তরে বিবর্তন