বিবর্তনের আর্কাইভ
বিবর্তন নিয়ে প্রশ্ন
সাগর বা হ্রদের পানির নীচের মাছগুলো অত অপরূপ রঙীন হতে গেল কেন?
১) বিবর্তন কোন লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বা পরিকল্পণা নিয়ে কাজ করে না, কাজ করে অনেকটা ‘ব্লাইন্ড ওয়াচমেকারের’ মত। কাজেই কোন কিছুর ‘জন্য’ বা কোন ‘উদ্দেশ্য’ সামনে রেখে মাছেদের এমন মন মাতাল করা রং হয়নি। এভাবে ভাবাটাই আসলে ভুল। সঠিক প্রশ্নটি হবে – মাছের গায়ের রঙ কি তাদের তাদের টিকে থাকার পেছনে কোন বাড়তি উপযোগিতা দিয়েছিলো? এটা একটা ভাল প্রশ্ন। এর উত্তর হচ্ছে, বিবর্তনের সবকিছুই যে অভিযোজন কিংবা ‘বাড়তি উপযোগিতা’ নির্ভর তা কিন্তু নয়। বহু কিছু উদ্ভুত হয়েছে অন্য অনেক কিছুর অভিযোজনের ‘বাই-প্রোডাক্ট’ হিসবে, কিংবা ‘র্যাণ্ডম ড্রিফটের’ ফসল হিসেবে। যেমন, আমাদের হাড়ের যে সাদা রঙ এটাকে অভিযোজন বা এডাপ্টেশন দিয়ে ব্যাখ্যা করলে চলবে না। কারণ অভিযোজনের দিক দিয়ে হাড়ের সাদা রঙ এর কোন বাড়তি মূল্য নেই। আমাদের হাড় যে ক্যালসিয়াম দিয়ে তৈরি তার ফলশ্রুতিতে ‘বাই প্রোডাক্ট’ হিসেবে এই সাদা রঙ তৈরি হয়েছে। আমাদের মানুষদের গায়ের রঙও কিন্তু ভিন্ন হয়। চুলের রঙ কারো সাদা, কারো কালো, কারো বা বাদামি। চোখের মনি কারো নীল, কারও কটা, কারো বা সবুজ। হয়ত এগুলো কোনটারই অভিযোজিত সুবিধার জন্য হয়নি। হয়েছে অন্য কোন কারণের উপজাত হিসেবে। মানুষের সাদা হাড্ডি কিংবা চোখের মনির বিভিন্ন রঙের মত মাছের রংও বাইপ্রোডাক্ট হিসবে তৈরি হতে পারে, অসম্ভব কিছু নয়[1]।
২) এখন কথা হচ্ছে, এই রঙবেরঙের ব্যাপারটা তো মাছেদের ক্ষেত্রে হুমকি হবার কথা। শিকারী মাছদের চোখে পরে যাওয়ার কথা তাই না? কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো হয়ই। কিন্তু তারপরও কেন রঙ বেরঙের মাছগুলো টিকে থাকল এর ভাল ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীদের কাছে আছে। যেমন, উগান্ডা কেনিয়া এবং তাঞ্জানিয়ার চারিদিকে পরিবেষ্টিত ভিক্টরিয়ান হ্রদে গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন- লাল কমলা ইত্যাদি গাঢ় রঙের মাছগুলো মুলত থাকে হ্রদের নিচের দিকে কারণ লাল রঙের আলো নীলচে আলোর চেয়ে হ্রদের অনেক বেশি গভীরে যায়। সাদা সবুজ আর হাল্কা রঙের মাছগুলো থাকে পানির উপর দিকে। এভাবেই রঙের তারতম্য এবং পানির গভীরতাকে কাজে লাগিয়ে তারা শিকারীদের চোখ এড়িয়ে টিকে থাকে। ভিক্টরিয়ান হ্রদে রঙের এই তারতম্যকে পুঁজি করে পৃথক প্রজাতিই তৈরি করে ফেলেছে মাছেরা[2],[3]।
৩) ডারউইন বর্নিত সেক্সুয়াল সিলেকশন বা যৌনতার নির্বাচন থেকেও রঙীন মাছদের অস্তিত্বের ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, হ্রদের গভীরে নীল আলো কম পৌছানোর কারণে সেখানে নীল রঙের মাছদের অনেক ফ্যাকাশে দেখায়। হ্রদের গভীরে লাল রঙের মাছেরাই অনেক বেশী নারী মাছদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়, এবং তারাই দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে সেই পরিবেশে। আবার অন্যদিকে হ্রদের উপরের দিকে নীল আলোর প্রতিসরণের কারণে সেখানে নীল রঙের মাছেরাই থাকে উজ্জ্বল, তারাই অধিকতর সফল হয়। এভাবে যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে অন্তরণ (isolation) ঘটে ক্রমান্বয়ে দুই ধরণের প্রজাতি তৈরি হয়[4]। নীচে ছবির সাহায্যে ব্যাপারটি বোঝানো হল -
চিত্র : আলোর প্রতিসরণ এবং যৌনতার নির্বাচনকে পুঁজি করে আফ্রিকার ভিক্টোরিয়া হ্রদের ভিন্ন গভীরতায় মাছেদের পৃথিক প্রজাতি তৈরি হয়েছে
৪) এ ছাড়া অনেক মাছই গায়ের রঙ এর সাথে মিলিয়ে আলোর প্রতিসরণ, সামুদ্রিক গাছ-পালা আর পরিবেশ বাছাই করে সহ-বিবর্তন বা ‘কো-ইভলুশন’ গড়ে তুলে নিজেদের টিকিয়ে রাখে। এমনি একটি চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে ‘কালারফুল ক্লাউন’ মাছের সাথে এনিমোনের সহবিবর্তন। এ ধরনের মাছ তার গাঢ় রঙের কারণে সহজেই অন্যের শিকারে পরিণত হতে পারে, আত্মরক্ষার জন্য গাঢ় রঙের সামুদ্রিক এনিমোনের শুঁড়ের ভিতর প্রায়শঃই আত্মগোপন করে। এভাবে ক্লাউন মাছগুলো শিকারী মাছের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে সমর্থ হয়। আবার অন্যদিকে এনিমোনগুলোও ক্লাউন মাছের কারণে উপকৃত হয়। কারণ ক্লাউন মাছগুলো এনিমোনভোগী ছোট মাছকে তাড়িয়ে দেয়। কাজেই দেখা যাচ্ছে, এই ক্লাউন মাছগুলো গায়ের রঙকে কাজে লাগিয়েই সহবিবর্তনের মাধ্যমে শিকারি মাছদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলেছে।
চিত্র : ক্লাউন মাছ আর এনিমোনের সহবিবর্তন
[1] অভিজিৎ রায়, বিবর্তনের সহজ পাঠ, যুক্তি, সংখ্যা ৩, জানুয়ারী ২০১০; অন লাইন - এক বিবর্তনবিরোধীর প্রত্যুত্তরে, মুক্তমনা।
[2] Boughman, J. W. How sensory drive can promote speciation. Trends in Ecology and Evolution 17(12):571-577, 2002.
[3] Maan, M. E., Seehausen, O., and Van Alphen, J. J. M. Female preferences and male coloration covary with water transparency in a Lake Victoria cichlid fish. Biological Journal of the Linnean Society. 99: 398-406, 2010
[4] Seehausen, O., van Alphen, J. J. M., and Witte, F.. Cichlid fish diversity threatened by eutrophication that curbs sexual selection. Science 277(5333):1808-1811, 1997