বিবর্তনের আর্কাইভ
ভ্রান্ত ধারণা
বিবর্তন মানব-সমাজে নৈতিকতার উদ্ভবকে ব্যাখ্যা করতে পারে না।
নৈতিকতার ব্যাপারটি শুধু মানব সমাজেরই একচেটিয়া তা নয়, ছোট স্কেলে তথাকথিত অনেক 'ইতর প্রাণী' জগতের মধ্যেও কিন্তু এটি দেখা যায়। ভ্যাম্পায়ার বাদুরেরা নিজেদের মধ্যে খাদ্য ভাগাভাগি করে, বানর এবং গরিলারা তাদের দলের কোন সদস্য মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত থাকলে তাকে সহায়তা করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে, এমনকি 'দশে মিলে' কাজ করে তার জন্য খাবার পর্যন্ত নিয়ে আসে। ডলফিনেরা অসুস্থ অপর সহযাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে সৈকতের দিকে নিয়ে যায়, যার ফলে অসুস্থ ডলফিনটির পর্যাপ্ত আলো বাতাস পেতে সুবিধা হয়, তিমি মাছেরা তাদের দলের অপর কোন আহত তিমি মাছকে দ্রুত সারিয়ে তুলতে চেষ্টা করে। হাতীরা তাদের পরিবারের অসুস্থ বা আহত সদস্যকে বাঁচানোর জন্য সবোর্চ্চ ত্যাগ স্বীকার করে। এ ধরনের দৃষ্টান্ত বিরল নয়।
বিবর্তন তত্ত্ব আমাদের খুব ভালভাবেই দেখিয়েছে জিনগত স্তরে স্বার্থপরতা কিংবা প্রতিযোগিতা কাজ করলেও, জিনের এই স্বার্থপরতা থেকেই পরার্থতার মতো অভিব্যক্তির উদ্ভব ঘটতে পারে (এপ্রসঙ্গে অল্প কথায় জানতে চাইলে পড়ুন মুক্তমনায় রাখা- দিগন্ত সরকারের ‘স্বার্থপর জিন’ -এর আলোকে সহযোগিতা এবং আত্মত্যাগ প্রবন্ধটি অথবা অভিজিৎ রায়ের লেখা 'বিবর্তনের দৃষ্টিতে নৈতিকতার উদ্ভব' (১, ২) নামের দুই পর্বের এ সিরিজটি)। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পরার্থতার উদ্ভবের ব্যাপারটি শিক্ষায়তনে গবেষণার মাধ্যমে প্রথমবারের মত তুলে ধরেন বিজ্ঞানী উইলিয়াম হ্যামিলটন[1]।পরবর্তীতে ধারনাটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন স্বনামখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স তার 'সেলফিশ জিন' বইয়ের মাধ্যমে[2]। এই বইয়ের মাধ্যমেই আসলে জীববিজ্ঞানীরা সমাজ এবং জীবনকে ভিন্নভাবে দেখা শুরু করলেন। পরার্থতা, আত্মত্যাগ, দলগত নির্বাচনের মত যে বিষয়গুলো আগে বিজ্ঞানীরা পরিস্কার করে ব্যাখ্যা করতে পারতেন না, সেগুলো আরো বলিষ্ঠভাবে জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে ব্যখ্যা করতে পারলেন।
শুধু মানুষ নয় অন্য যে কোন প্রানীর মধ্যেই সন্তানদের প্রতি অপত্য স্নেহ প্রদর্শন কিংবা সন্তানদের রক্ষা করার জন্য মা বাবারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে। অর্থাৎ, নিজের দেহকে বিনষ্ট করে হলেও পরবর্তী জিনকে রক্ষা করে চলে। ‘পরবর্তী জিন’ রক্ষা না পেলে নিজের দেহ যত সুষম, সুন্দর, শক্তিশালী আর মনোহর কিংবা নাদুস-নুদুস হোক না কেন, বিবর্তনের দিক থেকে কোন অভিযোজিত মূল্য নেই। সেজন্যই নেকড়ে যখন আক্রমণ করে, গোত্রের ছোট বাচ্চাদের রক্ষা করার জন্য বুনো মোষেরা বাচ্চাদের চারিদিকে ঘিরে শিং উঁচিয়ে নেকড়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, নিজেদের জীবনকে বিপন্ন করে হলেও। এভাবেই জীব নিজেকে বিবর্তনের পথ ধরে এমনভাবে নিয়ে চলে যাতে তার জিন-বিস্তারে কিংবা ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষায় উদ্যোগী হয়, টিকে থাকার প্রয়োজনেই। আসলে যার সাথে সে বেশী জিন বিনিময় করবে, যত ঘনিষ্ঠতা বাড়াবে, তত বাড়বে নিজের জিন বিস্তারের সম্ভাবনা, সেজন্যই, সন্তানের প্রতি, পরিবারের প্রতি, নিকটাত্মীয়রের প্রতি এবং গোত্রের প্রতি একধরনের জৈবিক টান উপলব্ধি করে, এবং তাদেরকে রক্ষার চেষ্টা করে। বিজ্ঞানীরা আরো দেখেছেন, স্বার্থপর জিন যেমন আত্মত্যাগ কিংবা পরার্থতা তৈরি করে, ঠিক তেমনি আবার প্রতিযগিতামূলক জীবন সংগ্রাম থেকেই জীবজগতে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরণের পারষ্পরিক সহযোগিতা, মিথোজীবীতা কিংবা সহ-বিবর্তন। টিকে থাকার প্রয়োজনেই কিন্তু এগুলো ঘটে। শিকারী মাছদের থেকে বাঁচার জন্য ক্লাউন মাছদের সাথে এনিমোনের সহবিবর্তন, হামিং বার্ডের সাথে অর্নিথোপথিলাস ফুলের সহবিবর্তন, এংরাকোয়িড অর্কিডের সাথে আফ্রিকান মথের সহবিবর্তন এগুলোর প্রত্যক্ষ উদাহরণ প্রকৃতেই আছে।
কোন শিকারী পাখি যখন কোন ছোট পাখিকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করে, তখন অনেক সময় দেখা যায় যে গোত্রের অন্য পাখি চিৎকার করে ডেকে উঠে তাকে সতর্ক করে দেয়। এর ফলশ্রুতিতে সেই শিকারী পাখি আর তার আদি লক্ষ্যকে তাড়া না করে ওই চিৎকার করা পাখিটিকে আক্রমণ শুরু করে। এই ধরনের পরার্থতা এবং আত্মত্যাগ কিন্তু প্রকৃতিতে খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখা যায়। এই ব্যাপারগুলো বিবর্তনের কারণেই উদ্ভুত হয়েছে। এই ব্যাপারগুলো ঘটে বিবর্তনের গেম থিওরীর মাধ্যমে ঘটা স্থিতিশীল কৌশল রাজত্ব করার কারণে। মুক্তমনার ই-বুক -বিজ্ঞান ও ধর্ম: সংঘাত নাকি সমন্বয়?- এর পঞ্চম অধ্যায়ে (ধর্ম, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ)-এ সন্নিবেশিত লেখা গুলো পড়ে দেখা যেতে পারে[3]। মুক্তমনায় রাখা প্রবন্ধগুলোতে বাংলায় প্রথমবারের মতো মেনার্ড স্মিথের সহ অন্যান্য বিজ্ঞানীদের গানিতিক মডেলের উল্লেখ করে দেখানো হয়েছে যে, শুধু প্রতিযোগিতা কিংবা বিবাদ করলে জীনপুলকে সর্বোচ্চ দক্ষতায় বাঁচিয়ে রাখা যায় না, সাথে আনতে হয় সহযোগিতা এবং পরার্থতার কৌশলও । ম্যাট রিডলী তার নৈতিকতার উদ্ভব ('দ্য অরিজিন অব ভার্চু') বইয়ে নৈতিকতার বিবর্তনীয় উৎস নিয়ে চমৎকার আলোচনা করে দেখিয়েছেন বিবর্তন নৈতিকতার উন্মেষকে সহজেই ব্যাখ্যা করতে পারে[4]।
মুক্তমনায় প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ :
[1] Hamilton W.D., The genetical evolution of social behaviour I and II. — Journal of Theoretical Biology 7: 1-16 and 17-52, 1964.
[2] Richard dawkins, The Selfish Gene. Oxford: Oxford University Press. 1976.
[3] মুক্তমনা ইবুক, ‘বিজ্ঞান ও ধর্ম – সংঘাত নাকি সমন্বয়?’, সম্পাদনা অভিজিৎ রায়
[4] Matt Ridley, The Origins of Virtue: Human Instincts and the Evolution of Cooperation, Penguin, 1 edition, 1998