বিবর্তনের আর্কাইভ
বিবর্তন নিয়ে প্রশ্ন
বিবর্তন মানে কি কেবল মারামারি কাটাকাটি ?
১) অনেকেই বিবর্তনের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন। তারা মনে করেন বিবর্তন মানে হচ্ছে কেবলই মারামারি কাটাকাটি - একজনকে দাবড়িয়ে আরেকজনের বেঁচে থাকা। আসলে কিন্তু তা মোটেই নয়। প্রকৃতি জগতে প্রতিযোগিতা আছে, ভালমতই আছে। কিন্তু একে স্রেফ মারামারি কাটাকাটি দিয়ে ব্যাখ্যা করা বালখিল্যই। প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার নিয়ে প্রজাতিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে আমাদের চারপাশে একটু চোখ মেলে তাকালেই। আমাদের চারপাশের উদ্ভিদ এবং প্রাণীরা যে পরিমাণে বংশবৃদ্ধি করে তার বেশীরভাগই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না। চমৎকার কিছু উদাহরণ দেওয়া আছে ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ বইটিতে[1]। সেখান থেকে কিছু উদাহরণ হাজির করা যাক। একটা পুরোপুরি বড় হওয়া কড মাছ বছরে প্রায় ২০ থেকে ৫০ লাখ ডিম পাড়ে, একটি মেপল বা আম বা জাম গাছে হাজার হাজার ফুল এবং ফল ধরে, কিন্তু এর বেশীরভাগই পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করার আগেই মৃত্যুবরণ করে, আমাদের দেশের ইলিশ মাছের কথাই চিন্তা করে দেখুন না। সমুদ্র থেকে নদীগুলোতে এসে তারা কি হারে ডিম পারে আর তাদের মধ্যে ক’টাই বা শেষ পর্যন্ত পুর্ণাঙ্গ মাছে পরিণত হয়ে টিকে থাকতে পারে! বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখিয়েছেন যে একটা কড মাছের ডিমের ৯৯% ই প্রথম মাসেই কোন না কোন ভাবে ধ্বংস হয়ে যায়, বাকি যা বেঁচে থাকে তার প্রায় ৯০% জীবনের প্রথম বছরেই কোন না কোনভাবে মৃত্যুবরণ করে। ডারউইনও তার বইয়ে এই একই জিনিস দেখিয়েছেন হাতীর বংশবৃদ্ধির উদাহরণ দিয়ে। অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় হাতীর বংশবৃদ্ধির হার তুলনামুলকভাবে খুবই কম, কিন্তু তারপরও একটা হাতী তার জীবনে যে ক’টা বাচ্চার জন্ম দেয় তার মধ্যেও সবগুলি শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে না। ডারউইন হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, হাতী অন্য সব প্রাণীর তুলনায় সবচেয়ে কম বংশবৃদ্ধি করেও তার ৯০-১০০ বছরের জীবনে প্রায় ৬ টি বাচ্চার জন্ম দিতে পারে। অর্থাৎ যদি সবগুলো বাচ্চা বেঁচে থাকে তাহলে এক জোড়া হাতী থেকে ৭০০-৭৫০ বছরে প্রায় ১৯০ লক্ষ হাতীর জন্ম হবে । প্রকৃতিতে প্রায় সব জীবই এরকম বাড়তি শিশুর জন্ম দিয়ে থাকে, একটা ব্যকটেরিয়া প্রতি ২০ মিনিটে বিভক্ত হয়ে দুটো ব্যকটেরিয়ায় পরিণত হয়, হিসেব করে দেখা গেছে যে এরা সবাই বেঁচে থাকলে এক বছরে তারা বংশ বৃদ্ধি করে সারা পৃথিবী আড়াই ফুট উচু করে ঢেকে দিতে পারতো। একটা ঝিনুক কিংবা কাছিম একবারে লাখ লাখ ডিম ছাড়ে, একটা অর্কিড প্রায় ১০ লাখ বীজ তৈরী করতে পারে। মানুষের ব্যাপারটা খানিকটা ব্যতিক্রম। কারণ চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে মানুষ প্রকৃতির উপর ছড়ি ঘুরাতে শুরু করেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এতখানি উন্নতি ঘটার আগে অর্থাৎ মাত্র একদেড়শো বছর আগেও শিশু মৃত্যর হার ছিল অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক বেশী। আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে, কৃত্রিমভাবে আমরা এখন একদিকে জন্ম নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করছি, অন্যদিকে শিশু আধুনিক চিকিৎসার কল্যানে মৃত্যুর হারও কমিয়ে আনতে পেরেছি। তারপরো সীমিত সম্পদের উপর প্রতিযোগিতার ব্যাপারটা কারো অগোচরে থাকে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এভাবেই সব জীব যদি বংশবৃদ্ধি করতে থাকতো, অর্থাৎ একেকটা জীব তার সারা জীবনে যতগুলো ডিম বা বাচ্চার জন্ম দিতে সক্ষম তার সব গুলো যদি টিকে থাকতো তাহলে এতদিনে পৃথিবীতে আর কারোরই থাকার ঠাঁই হতো না। আসলে খেয়াল করলে দেখা যায় যে, প্রকৃতিতে ঠিক এর উলটোটা ঘটছে – সংখ্যার দিক থেকে যত উদ্ভিদ বা প্রাণীর জন্ম হয় বা বেঁচে থাকে, তার তুলনায় তাদের বংশবৃদ্ধি করার ক্ষমতা বহু গুণ বেশী। শেষ পর্যন্ত এর মধ্যের ছোটটো একটা অংশই শুধু বড় হওয়া পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। যে কোন প্রজাতি হঠাৎ করে অনেক বেশী হারে বংশবৃদ্ধি করে ফেলতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের বিস্তৃতি প্রাকৃতিক নিয়মেই বন্ধ হতে হবে। কারণ, তাদের সবার বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমান খাদ্যের বা অন্যান্য সম্পদের প্রয়োজন তা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ডারউইন ভাবলেন, তাহলে প্রকৃতিতে প্রাণের এই বিশাল অপচয় এবং বাড়তি বংশবৃদ্ধির ব্যাপারটার অবশ্যই কোন ব্যাখ্যা থাকতে হবে! ডারউইন প্রথমবারের মত বিবর্তন তত্ত্বের সাহায্যে এর একটি ব্যাখ্যা দেন। তিনি পর্যবেক্ষণ থেকে সঠিকভাবেই সিদ্ধান্তে আসেন যে, প্রকৃতিতে সবসময় খাদ্য, বেঁচে থাকা, জায়গা, সঙ্গী নির্ধারণ, আশ্রয়, এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে একধরনের নিরন্তর প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। তিনি এর নাম দেন জীবন সংগ্রাম (struggle for survival)। এই বেঁচে থাকার সংগ্রাম চলতে থাকে একই ধরনের প্রজাতির ভিতরের প্রতিটি জীবের মধ্যে এবং এক প্রজাতির সাথে আরেক প্রজাতির মধ্যে। আবার প্রতিটি জীবের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য বা প্রকারণের কারণে এই অনন্ত প্রাকৃতিক সংগ্রামে কেউ বা সহজেই খাপ খাইয়ে নিয়ে বেশীদিন টিকে থাকতে সক্ষম হয়, আর অন্যরা আগেই শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রতিটি জীবের মধ্যে প্রকৃতি তুলনামুলকভাবে বেশী উপযুক্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের টিকিয়ে রাখে। সোজা কথায়, একটা নির্দিষ্ট পরিবেশে সংগ্রাম করে যারা টিকে থাকতে সক্ষম হয়, তারাই শুধু পরবর্তী প্রজন্মে বংশধর রেখে যেতে পারে, এবং তার ফলে তাদের বৈশিষ্ট্যগুলোরই পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে অনেক বেশী প্রকটভাবে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ, যে প্রকারণগুলো তাদের পরিবেশের সাথে অপেক্ষাকৃত বেশি অভিযোজনের ক্ষমতা রাখে, তাদের বাহক জীবরাই বেশীদিন টিকে থাকে এবং বেশী পরিমানে বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। এভাবে প্রকৃতি প্রতিটা জীবের মধ্যে পরিবেশগতভাবে অনুকুল বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের নির্বাচন করতে থাকে এবং ডারউইন প্রকৃতির এই বিশেষ নির্বাচন প্রক্রিয়ারই নাম দেন প্রাকৃতিক নির্বাচন। আসলে জীবজগতে বিবর্তন হয় বলেই আমরা সর্বত্র চরম বিশৃংখলার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছি, এর উল্টোটি হলে হতো না।
২) প্রকৃতির এই প্রতিযোগিতাকে এত খারাপ চোখে দেখারও কিছু নেই। প্রতিযগিতামূলক জীবন সংগ্রাম থেকেই তৈরি হয় বিভিন্ন ধরণের পারষ্পরিক সহযোগিতা, মিথোজীবীতা কিংবা সহ-বিবর্তন। শিকারী মাছদের থেকে বাঁচার জন্য ক্লাউন মাছদের সাথে এনিমোনের সহবিবর্তনের কথা আমরা জানি।
ছবিঃ ক্লাউন মাছ আর এনিমোনের সহবিবর্তন
আমাদের দেহেও বাস করে অনেক উপকারী ব্যাক্টেরিয়া। আমাদের দেহে বাস করার ফলে আমরা যেমন এদের দিয়ে উপকৃত হচ্ছি, তেমনি সেই ব্যাকটেরিয়াগুলোঅ উপযূক্ত পোষক দেহ পেয়ে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারছে। ডারউইন নিজেও সহবিবর্তনের অনেক উদাহরণ হাজির করেছিলেন, নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে। তিনি লন্ডনের এক গ্রীন হাউসে মাদাগাস্কারের বিশেষ একটা অর্কিড দেখেন যার মধু রাখার পুষ্পাধারটি ১১ ইঞ্চি লম্বা । তিনি তা দেখে মন্তব্য করেন যে, মাদাগাস্কারের যে জায়গায় এই অর্কিডটা দেখা যায়, সেখানে এমন এক ধরনের মথ জাতীয় কোন পোকা থাকতেই হবে যাদের সুর বা হুল হবে একই রকমের লম্বা। কারণ এই লম্বা মধুর পুষ্পাধারের ভিতর শুর ঢুকিয়ে মধু খাওয়ার সময়ই মথগুলো অর্কিডটার পরগায়ন ঘটাবে। এবং তাইই হলো – কয়েক দশক পরে বিজ্ঞানীরা ঠিকই খুঁজে পেলেন সেই মাদাগাস্কার স্ফিংস মথ Xanthopan morganii praedicta। আসলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটা নিরন্তর প্রতিযোগিতার কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যাবার ফলে নিজেদের টিকিয়ে রাখতেই বিভিন্ন প্রাণি এবং উদ্ভিদ অনেক সময়ই নিজেদের মধ্যে এক ধরনের সহযগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলে। এ ধরোনের উদাহরণ আছে বহু। হামিং বার্ডের সাথে অর্নিথোপথিলাস ফুলের সহবিবর্তন, এংরাকোয়িড অর্কিডের সাথে আফ্রিকান মথের সহবিবর্তন এগুলওর প্রত্যক্ষ উদাহরণ। কোন সেবমূলক কাজে উৎসাহিত হয়ে নয় কিংবা উপকারি মনোভাবের বহিঃপ্রকাশের ফলে নয়, বরং কঠিণ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার প্রয়োজনেই মূলতঃ তারা পারস্পরিক সহযোগিতায় যেতে তারা বাধ্য হয়। আসলে প্রকৃতিতে এমন কোন জীব নেই যে শুধু নিঃস্বার্থভাবে অন্য প্রজাতির সেবা করার জন্য বেঁচে থাকে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়মেই সে বিলুপ্ত হয়ে যেতে বাধ্য। ডারউইন তার ‘অরিজিন অব স্পিশিজ’ বইতে তার পাঠকদেরকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এ ধরণের একটা প্রজাতি খুঁজে বের করার জন্য, এবং আজ পর্যন্ত কেউ সে চ্যালেঞ্জের উত্তর দিতে পারেনি[2]।
৩) বিবর্তনকে মারামারি কাটাকাটির সাথে তুলনা করা কিংবা বিবর্তন সত্য হলে সর্বত্র বিশৃংখলা দেখে দেবে বলা মূলতঃ ন্যাচারালিস্টিক ফ্যালাসির উদাহরণ। প্রকৃতিতে কিভাবে প্রজাতির উদ্ভব আর বিকাশ ঘটছে তা বিবর্তন তত্ত্ব স্বার্থকভাবে ব্যাখ্যা করে, কিন্তু এর জন্য কোথায় শৃঙ্খলা বা বিশৃংখলা দেখা দেবে সেটা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায় না[3]।
[1] বন্যা আহমেদ, বিবর্তনের পথ ধরে, অবসর, ২০০৭ (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত ২০০৮)।
[2] অভিজিৎ রায়, বিবর্তনের সহজ পাঠ, যুক্তি, সংখ্যা ৩, জানুয়ারি ২০১০; এক বিবর্তনবিরোধীর প্রত্যুত্তরে, মুক্তমনা
[3] Mark Isaak, The Counter-Creationism Handbook, University of California Press, 2007