উল্টোস্রোতের কুলঠিকানা- প্রসঙ্গ লিটল ম্যাগাজিন... (এক)
রণদীপম বসু
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই, তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল।’
--- প্রাচীন গ্রীক কবি ইউরিপিডিস
(৪৮০-৪০৬ খ্রীঃ পূঃ)
নান্দীপাঠ
দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে কলেবর বাড়িয়ে দিলেই যেমন ‘বড় কাগজ’ হয় না, তেমনি তা কমিয়ে দিলেও ‘ছোট কাগজ’ হয়ে যায় না। নতুন স্বর ও সাহসী উচ্চারণে যা নাকি সত্যনিষ্ঠ তীক্ষ্ণধার ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে এস্টাব্লিশম্যান্ট বা প্রাতিষ্ঠানিকতার গড্ডালিকাময় অসারতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারে, সেটাই ‘ছোট কাগজ’। এই যে দেখিয়ে দেয়ার কাজ, সেটা দু’ভাবে হতে পারে। এক, প্রাতিষ্ঠানিকতার লেবেল মারা চলমান ধারাটা যে সৃজনশীলতার সক্ষমতা হারিয়ে বয়ান পুনর্বয়ানের বর্জ্য ঘেটে ঘেটে একঘেয়েমীর রুচিহীন বরাহস্বভাবে উপনীত হয়েছে, তা চিহ্নিত করে পাঠকরুচিকে পুনর্মূল্যায়নে যৌক্তিক আহ্বান জানানো। দুই, প্রথাবিরোধী নতুন স্বরযোজনার মধ্য দিয়ে পুরনো ধারাকে ইঙ্গিতময় অবসরে ঠেলে দিয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক শক্তি অর্জনে পাঠকচিত্তকে নিজের দিকে আকর্ষণ করা। উভয়ক্ষেত্রেই এর প্রধান কাজটি হলো পুরনোকে অস্বীকার করা। স্পষ্ট উচ্চারণে জানিয়ে দেয়া, ব্যাক-ডেটেড ধারণার দিন শেষ, এবার আপ-টু-ডেট নতুনের পালা। কিন্তু এই অস্বীকারের কাজটি তো আর এমনি এমনি হয় না। এ জন্যে যে নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সৃজনশীল উন্মেষ ঘটাতে হয়, তা পারে কেবল তরুণেরাই। আরো স্পষ্ট করে বললে- তারুণ্য। নবীন বযেসীদেরকেই সাধারণত তরুণ বলা হলেও তারুণ্য কিন্তু বয়সনির্ভর নয়। তারুণ্য একটি বহমান সত্তা। সৃজনশীল অগ্রযাত্রাই তারুণ্যের আসল মাপকাঠি। অতএব, লিটল ম্যাগাজিন মানেই তারুণ্যের পতাকা। সৃষ্টির নেশায় মত্ত তারুণ্যের অবিচল ঝাণ্ডা। এই অবিচলতার প্রোথিত জমিনটাকে ফলনযোগ্য উর্বরতায় সমৃদ্ধ করতে চাই নবীন কোন দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গির প্রায়োগিক উজ্জ্বলতাও। এ আয়োজনেও পিছিয়ে থাকে না লিটল ম্যাগাজিন। তাই লিটল ম্যাগাজিন হলো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যবাহী, সাহিত্যমননে এস্টাব্লিশম্যান্ট বিরোধী সৎ ও রুচিশীল তারুণ্যের সৃজনশীল সাহিত্যপত্র। এখানেই সংকলনপত্রের সাথে লিটল ম্যাগাজিনের মৌলিক পার্থক্য। অন্তত লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাস আমাদেরকে তাই শেখায়।
জন্মস্বরে ডেকে ওঠে আজন্মের ক্রোধ
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে লিটল ম্যাগাজিনের প্রচার ও প্রসার ঘটলেও এর জন্মকোষ্ঠী খুঁজতে গেলে আমাদের চলে যেতে হবে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সেই The Dail (Boston,1840-1844) পত্রিকাটির কাছে। Ralph Waldo Emerson ও Margaret Fuller সম্পাদিত এ পত্রিকাটিকেই এ অঙ্গনের চিন্তকেরা লিটল ম্যাগাজিনের আদিরূপ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আসছেন। এলিয়টের বিশ্বনন্দিত ‘ওয়েস্টল্যাণ্ড’ এই ‘ডায়াল’-এ প্রথম ছাপা হয়। তবে পত্রিকা শব্দটি কীভাবে ‘ম্যাগাজিন’ শব্দরূপ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়ে গেলো তা জানতে হলে আমাদেরকে আরো পিছনে যেতে হয়। ১৭৩১ সালে এডওয়ার্ড কেভ সম্পাদিত `Gentleman's Magazine’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে ম্যাগাজিন শব্দটি চালু হয়। Magazine অর্থ- বারুদশালা। বারুদ ঠাসার মতোই শব্দ-অক্ষরের মাল-মশলা মজুদের আধার হিসেবে ম্যাগাজিন শব্দের এই প্রতীকী ব্যবহারই পরবর্তীতে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শুধুমাত্র বাঁধানো পত্র পত্রিকার ক্ষেত্রেই ‘ম্যাগাজিন’ শব্দটি ব্যবহার হতো। তবে ‘লিটল ম্যাগাজিন’ নামের এই যুগ্ম শব্দের ব্যবহার আঠারো শতকের শেষ দশকে বা উনিশ শতকের প্রথম দশকে ইউরোপে শুরু হয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়। বিগ বাজেটের পণ্যসর্বস্ব সাহিত্যের বিপরীতে নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নব-সাহিত্য প্রেরণা হিসেবে এক বিশেষ রীতির পত্রিকাকেই ‘লিটল ম্যাগাজিন’ অভিধায় চিহ্নিত করা হয়। এ ক্ষেত্রে Margaret Anderson সম্পাদিত The Little Review (Chicago, San Francisco, New York, Paris, 1914-1929) কেই সর্বাগ্রে বহুল ব্যবহৃত দৃষ্টান্ত হিসেবে আনা হয়ে থাকে। জেমস জয়েসের বিখ্যাত উপন্যাস ‘ইউলিলিস’ এর প্রথম এগার অধ্যায় ছাপা হয় এ পত্রিকায়। সে সময়কালের চেতনাপ্রবাহী অন্যান্য লিটল ম্যাগাজিনের মধ্যে রয়েছে- Poetry (1912), The Egoist (London, 1914-1919), New Masses (1926-1948), The Anvil (1933-1939), Blast (1933-1934), New Verse (London, 1933-1939), Criterion (London, 1922-1939) ইত্যাদি। এজরা পাউণ্ড, টি.এস.এলিয়ট, জেমস জয়েস, হেমিংওয়ে- সহ সমকালীন লেখকরা এসব পত্রিকার মধ্য দিয়েই সৃষ্টিশীলতার বিচিত্রমুখী প্রবাহ ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর বাংলাসাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন (১৮৭২)-কে গননায় আনা হলেও সত্যিকারার্থে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্রকেই (১৯১৪) আধুনিক লিটল ম্যাগাজিনের আদিরূপ বলা হয়ে থাকে।
প্রকৃত অর্থে লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্রই হচ্ছে প্রতিবাদী ও তথাকথিত প্রতিষ্ঠান বিরোধী। আর তাই প্রথাবিরোধী মেধাবী সৃষ্টিশীলদের সাহিত্যচর্চার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হচ্ছে এই লিটল ম্যাগাজিন। এর মাধ্যমেই সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি, তরুণ লিখিয়েদের আনকোরা উপস্থাপন ও সাহিত্যের নানামুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়ে থাকে। আর আমাদের বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে লিটল ম্যাগাজিনের সম্পর্ক তো এক কথায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। তাই লিটল ম্যাগাজিনের আলোচনা আসলেই বাংলাভাষার অন্যতম খ্যাতিমান লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু’র নামটিও অবিচ্ছেদ্যভাবেই চলে আসে। চারিত্র্য বিশ্লেষণে লিটল ম্যাগাজিনের স্বরূপ কী হবে এ ব্যাপারে তাঁর ব্যাখ্যাকেই মোটামুটি সর্বজনগ্রাহ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ‘দেশ’ পত্রিকার মে ১৯৫৩ সংখ্যায় ‘সাহিত্যপত্র’ প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসু লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লেখেন-
“এক রকমের পত্রিকা আছে যা আমরা রেলগাড়িতে সময় কাটাবার জন্য কিনি, আর গন্তব্য স্টেশনে নামার সময় ইচ্ছে করে গাড়িতে ফেলে যাই- যদি না কোনো সতর্ক সহযাত্রী সেটি আবার আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বাধিত এবং বিব্রত করেন আমাদের। আর এক রকমের পত্রিকা আছে যা স্টেশনে পাওয়া যায় না, ফুটপাতে কিনতে হলেও বিস্তর ঘুরতে হয়, কিন্তু যা একবার হাতে এলে আমরা চোখ বুলিয়ে সরিয়ে রাখি না, চেয়ে-চেয়ে আস্তে আস্তে পড়ি, আর পড়া হয়ে গেলে গরম কাপড়ের ভাঁজের মধ্যে ন্যাপথলিন-গন্ধী তোরঙ্গে তুলে রাখি- জল, পোকা, আর অপহারকের আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য। যে সব পত্রিকা এই দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্গত হতে চায়- কৃতিত্ব যেইটুকুই হোক, অন্ততপে নজরটা যাদের উঁচুর দিকে, তাদের জন্য নতুন একটা নাম বেরিয়েছে মার্কিন দেশে; চলতি কালের ইংরেজি বুলিতে এদের বলা হয়ে থাকে লিটল ম্যাগাজিন।”
“লিটল কেন? আকারে ছোট বলে? প্রচারে ক্ষুদ্র বলে? না কি বেশি দিন বাঁচে না বলে? সব কটাই সত্য, কিন্তু এগুলোই সব কথা নয়; ঐ ‘ছোট’ বিশেষণটাতে আরো অনেকখানি অর্থ পোরা আছে। প্রথমত, কথাটা একটা প্রতিবাদ: এক জোড়া মলাটের মধ্যে সব কিছুর আমদানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বহুলতম প্রচারের ব্যাপকতম মাধ্যমিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। লিটল ম্যাগাজিন বললেই বোঝা গেলো যে জনপ্রিয়তার কলঙ্ক একে কখনো ছোঁবে না, নগদ মূল্যে বড়োবাজারে বিকোবে না কোনোদিন, কিন্তু- হয়তো কোনো একদিন এর একটি পুরোনো সংখ্যার জন্য গুণীসমাজে উৎসুকবার্তা জেগে উঠবে। সেটা সম্ভব হবে এই জন্যেই যে, এটি কখনো মন যোগাতে চায়নি, মনকে জাগাতে চেয়েছিলো। চেয়েছিলো নতুন সুরে কথা বলতে। কোনো এক সন্ধিক্ষণে, যখন গতানুগতিকতা থেকে অব্যাহতির পথ দেখা যাচ্ছে না, তখন সাহিত্যের ক্লান্ত শিরায় তরুণ রক্ত বইয়ে দিয়েছিলো- নিন্দা, নির্যাতন বা ধনক্ষয়ে প্রতিহত না হয়ে। এই সাহস, নিষ্ঠা, গতির একমুখিতা, সময়ের সেবা না করে সময়কে সৃষ্টি করার চেষ্টা- এইটেই লিটল ম্যাগাজিনের কুলধর্ম। এর এটুকু বললেই অন্যসব কথা বলে হয়ে যায়, কেননা এই ধর্ম পালন করতে গেলে চেষ্টা করেও কাটতি বাড়ানো যাবে না, টিকে থাকা শক্ত হবে, আকারেও মোটাসোটা হবার সম্ভাবনা কম। অবশ্য পরিপুষ্ট লিটল ম্যাগাজিন দেখা গেছে- যদিও সে সময়ে ও-কথাটার উদ্ভব হয়নি- যেমন এলিয়টের ‘ক্রাইটেরিয়ন’ বা আদিকালের ‘পরিচয়’। কিন্তু মনে রাখতে হবে তারা ত্রৈমাসিক ছিলো; সমসাময়িক গণসেব্য মাসিক পত্রের তুলনায় তারা যে ওজনে কত হালকা তা অল্প একটু পাটিগণিতেই ধরা পড়বে। ভালো লেখা বেশি জন্মায় না, সত্যিকার নতুন লেখা আরো বিরল; আর শুধু দুর্লভের সন্ধানী হলে পৃষ্ঠা এবং পাঠক সংখ্যা স্বতঃই কমে আসে। অর্থাৎ আমরা যাকে বলি সাহিত্যপত্র, খাঁটি সাহিত্যের পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন তারই আরো ছিপছিপে এবং ব্যঞ্জনাবহ নতুন নাম।”
“সাহিত্যের পত্রিকা- তার মানে সৃষ্টিশীল, কল্পনাপ্রবণ সাহিত্যের। যে সব পত্রিকা সাহিত্য বিষয়ক জ্ঞানের পরিবাহক, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব বা পাঠমূলক গবেষণায় লিপ্ত, দৃশ্যত কিছু মিল থাকলেও সাহিত্যপত্রের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। তারা বিশেষজ্ঞের পত্রিকা, জ্ঞানের একটি বিশেষ বিভাগে আবদ্ধ, আপন সম্প্রদায়ের বাইরে তাদের আনাগোনার রাস্তা নেই। কিন্তু সাহিত্যপত্রের দরজা খোলা থাকে সকলেরই জন্য, কেননা সাহিত্য যেখানে সৃষ্টি করে সেখানে তার আহ্বানে কোনো গণ্ডি নেই, যদিও সে আহ্বান শুনতে পায় কখনোবা পনেরো জন কখনো পনেরো লক্ষ মানুষ। আজকের দিনে যাদের কণ্ঠ লোকের কানে পৌঁছাচ্ছে না, যারা পাঠকের পুরনো অভ্যাসের তলায় প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে, তাদের এগিয়ে আনা, ব্যক্ত করে তোলাই সাহিত্যপত্রের কাজ। এর উল্টোপিঠে আছে যাকে বলে অম্নিবাস ম্যাগাজিন, সর্বসহ পত্রিকা; তাদের আয়তন বিপুল, বিস্তার বিরাট, সব রকম পাঠকের সব রকম চাহিদা মেটাবার জন্য ভুরি পরিমাণ আয়োজন সেখানে মাসে মাসে জমে ওঠে। বাছাই করা পণ্যের সাজানো গুছানো দোকান নয়, পাঁচমিশেলি গুদোম-ঘর যেন; সেখানে রসজ্ঞের কাম্যসামগ্রি কিছু হয়তো কোথাও লুকিয়ে আছে, কিন্তু বিজ্ঞাপনের গোলমাল পেরিয়ে বর্জাইস অরের অলিগলি বেয়ে সেই সুখধামে পৌঁছানো অনেক সময়ই সম্ভব হয় না- পাতা ওল্টাতেই শ্রান্ত হয়ে পড়তে হয়।
এসব পত্রিকা তাদেরই জন্য যারা নির্বিচারে পড়ে, শুধু সময় কাটাবার জন্য পড়ে- আর সংখ্যায় গরিষ্ঠতম তারাই। এদের মধ্যে উৎকৃষ্ট লেখাও থাকে না তা নয়, কিন্তু দৈবাৎ থাকে, কিংবা নেহাৎই লেখক বিখ্যাত বলেই থাকে; সেটা প্রকাশ নয় প্রচার মাত্র; তার পেছনে কোনো সচেতন সাহিত্যিক অভিপ্রায় থাকে না। এসব পত্রিকা শুধু সমাবেশ ঘটায়, সামঞ্জস্য সাধন করে না, যা সংগ্রহ করে তার ভেতর দিয়ে কিছু রচনা করে তোলার চেষ্টা এদের নেই; শুধু কালস্রোতে ভেসে চলা এদের কাজ; কোনো নতুন তরঙ্গ তোলা নয়।”
বুদ্ধদেব বসু’র এই ব্যাখ্যা থেকেই লিটল ম্যাগাজিন কী, কেন এবং গড়পরতা সাহিত্য-সংকলনপত্রের সাথে এর পার্থক্য কোথায় কীভাবে, তার একটা মোটামুটি রেখাচিত্র অংকিত হয়ে যায়।
কণ্ঠস্বর-সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ লিটল ম্যাগাজিনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন- “লিটল ম্যাগাজিন বলতে বুঝি যেটা সাহিত্যের নতুন পালাবদকে ধারণ করে। যে কাগজের ভেতর দিয়ে সাহিত্য নতুন পণ্যের দিকে পা দেয়- এটাকে বলে লিটল ম্যাগাজিন।”
লোকায়ত-সম্পাদক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন- “বাংলা ভাষায় ইংরেজির প্রভাবে লিটল ম্যাগাজিন কথাটা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু ১৯৫০-এর দশকে। কিন্তু তখনি এটা প্রচলন লাভ করেনি। কি বাংলায়, কি ইংরেজিতে কথাটা সকলে এক অর্থে ব্যবহার করেননি। কেউ জোর দিয়েছেন প্রতিবাদে, প্রতিরোধে, প্রথাবিরোধিতায়। কেউ জোর দিয়েছেন নতুনত্বে। কেউ জোর দিয়েছেন সৃজনশীলতায়। কেউ কেবল ভাঙতে চেয়েছেন, কেউ গুরুত্ব দিয়েছেন নবসৃষ্টিতে। কারো দৃষ্টি কেবল বর্তমানে, কারো দৃষ্টি ভবিষ্যতের দিকে। গতানুগতিতে অনীহ সকলেই। আমি মনে করি- লিটল ম্যাগাজিনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তার সৃষ্টিশীলতায় ও নবসৃষ্টির আন্দোলনে। লিটল ম্যাগাজিন নবচেতনা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে এবং লেখক ও পাঠকদের মধ্যে সেই নবচেতনাকে সঞ্চারিত করে দেওয়ার জন্য আন্দোলনে যায়। শ্রেষ্ঠ লিটল ম্যাগাজিনগুলো নতুন সাহিত্য-আন্দোলনের মুখপত্র। সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, সমাজচিন্তা, বিজ্ঞান ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই লিটল ম্যাগাজিন হতে পারে- হয়ে থাকে।”
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, বিভিন্ন সাহিত্যপত্র বা লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশের প্রেরণার উৎস ছিলো সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ভাবনা। জন ক্লার্ক মার্শম্যানের দিকদর্শন (১৮১৮), বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন (১৮৭২), ভারতী (১৮৭৭), হিতৈষী (১৮৭৮), সাহিত্য (১৮৯০), প্রবাসী (১৯০১), ভারতবর্ষ (১৯১০) ইত্যাদি পত্রিকা সেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছে। যদিও এগুলো কোনোভাবেই লিটল ম্যাগাজিন নয়, তবে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এসব পত্রিকার বিশেষ ভূমিকা ছিলো। প্রথাবিরোধী, মননশীল গদ্য নিয়ে যথার্থ লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু হয় মূলত প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্র (১৯১৪) দিয়ে। তারপর একে একে কল্লোল (১৯২৩), সওগাত (১৯২৬), শিখা (১৯২৭), কালি কলম (১৯২৭), প্রগতি (১৯২৭), পরিচয় (১৯৩১), পূর্বাশা (১৯৩২), কবিতা (১৯৩৫), চতুরঙ্গ (১৯৩৮), শনিবারের চিঠি (১৯২৪) ইত্যাদি। ১৯৪৭-এর পূর্ববর্তীকালে সাহিত্য ও সংস্কৃতির রাজধানী কলকাতা হওয়ায় আধুনিকতার জাগরণের সূত্রপাতও হয়েছে কলকাতাতেই। তাই এগুলোর মধ্যে ঢাকা থেকে বুদ্ধদেব বসু ও অজিত কুমার দত্ত সম্পাদিত প্রগতি (১৯২৭) এবং কুমিল্লা থেকে সঞ্জয় ভট্রাচার্য সম্পাদিত পূর্বাশা (১৯৩২) ছাড়া বাকি কাগজগুলো কলকাতা থেকেই বেরুতো।
৪৭ পরবর্তী বাংলাদেশে ৫০-এর দশকে লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষীণ একটি ধারা লক্ষ্য করা যায়। ফজল শাহাবুদ্দিন সম্পাদিত কবিকণ্ঠ, সিকান্দার আবু জাফর-এর সমকাল, ফজলে লোহানীর অগত্যা, মাহবুবুল আলম চৌধুরীর সীমান্ত, এনামুল হক সম্পাদিত উত্তরণ ইত্যাদি এই দশকের চিহ্ন বহন করে। তবে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল (১৯৫৭) প্রগতিবাদী-সৃষ্টিশীল হিসেবে উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করে।
৬০-এর দশকের আধুনিকতাবাদী ধারায় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কণ্ঠস্বর (১৯৬৫) প্রভাবশালী ম্যাগাজিন। এ ছাড়া উত্তরণ (১৯৫৮), বক্তব্য (১৯৬২), স্বাক্ষর (১৯৬৩), সাম্প্রতিক (১৯৬৪), নাগরিক (১৯৬৪) সহ প্রতিধ্বনি, যুগপৎ, স্যাড জেনারেশন, না, পূর্বমেঘ, সুন্দরম, পলিমাটি, বহুব্রীহী, কালস্রোত ইত্যাদি ম্যাগাজিন স্বাধীনতা উত্তরকালে এসেও বাংলাদেশের সূচনাপর্বে লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রাকে আরও গতিশীল করেছে।
পরবর্তীকালে আমাদের সাহিত্যে বলা চলে লিটল ম্যাগাজিনের জয়জয়কার। সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা ভাংচুর স্বরনির্মাণ যোজন বিয়োজন সবই এই লিটল ম্যাগাজিনকে ঘিরেই চর্চিত ও আবর্তিত হয়েছে এবং হচ্ছে। পাশ্চাত্যের আলোড়িত বিভিন্ন সাহিত্যতত্ত্ব দর্শনের নতুন নতুন ঢেউগুলোও এই লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমেই আছড়ে পড়ছে আমাদের অঙ্গনটাতে। রাজধানী ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা থেকে প্রচুর লিটল ম্যাগাজিন ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে, যা নাকি আমাদেরকে নতুন নতুন চিন্তাচেতনায় উদ্বেল করে নতুন নতুন সৃষ্টিপ্রবণতায় উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে। ছোটগল্প, সংস্কৃতি, লোকায়ত, রূপম, কিছুধ্বনি, একবিংশ, বিপ্রতীক, লিরিক, গাণ্ডীব, নিসর্গ, ঊষালোকে, উটপাখি, অলক্ত, প্রান্ত, ১৪০০, সুদর্শনচক্র, দ্রষ্টব্য, প্রাকৃত, শিকড়, বিবর, চালচিত্র, ছাপাখানা, জীবনানন্দ, প্রতিপদ, নান্দনিক, দ্বিতীয় চিন্তা, মধ্যাহ্ন, দ্রাবিড়, শুদ্ধস্বর, পূর্ণদৈর্ঘ্য, স্বাতন্ত্র্য, মঙ্গলসন্ধ্যা, প্রতিশিল্প, সুমেশ্বর, বিবিধ, পত্তর, শব্দশিল্প, শব্দপাঠ, নন্দন, ঋতপত্র, সমুজ্জ্বল সুবাতাস, ব্যাস, লোক, অক্ষর, ধাবমান, কর্ষণ, নান্দী, কালনেত্র, কবিতাপত্র, এণ্টিকক, সময়কাল, লাস্টবেঞ্চ ১১৫, মেইনরোড, ঘুড্ডি, গুহাচিত্র, বুকটান, সুনৃত, বিবিক্ত, পরাবাস্তব, উল্লেখ, উলুখাগড়া, শতদ্রু, লেখাবিল, চিহ্ন, জলসিঁড়ি, পর্ব, কোরাস, বেহুলা বাংলা, চর্যাপদ, কহন, অ, কালধারা, পুণ্ড্র, অভীপ্সা, নৃ, যুক্তি, ধীস্বর, বৃক্ষ, পোয়েট-ট্রি, তৃণমূল প্রভৃতি লিটল ম্যাগাজিন উল্টোস্রোতের কুলঠিকানা খোঁজার এই ধারাবাহিকতারই অংশ।
উল্টোস্রোতের কুলঠিকানা
লিটল ম্যাগাজিনের প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য হলো অপ্রাতিষ্ঠানিকতা ও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুবিমল মিশ্র তাঁর এক প্রবন্ধে তিনি বলেন-
“প্রতিষ্ঠান একটি ব্যাপক শক্তি, বিভিন্ন কেন্দ্রে তার ডালপালা ছড়ানো। প্রতিষ্ঠান সব সময়েই মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের বিরোধী। তার উদ্দেশ্য মুনাফা লোটা এবং যেন তেন প্রকারেণ ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীকে করায়ত্ত করা। পাঠককে শিল্প-সচেতন করা নয়, তার মনোরঞ্জন করা। শুধু আমাদের দেশেই নয়, সব দেশেই প্রতিষ্ঠান চায় সব রকম স্বাধীন অভিব্যক্তি, প্রকৃত সত্যের প্রকাশ বন্ধ করতে। তাদের হাতেই বিজ্ঞাপনযন্ত্র, সব রকমের প্রকাশমাধ্যমগুলো আর মূলত এই বিজ্ঞাপনের সাহায্যে সে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে।”
“এক কথায় বলতে গেলে প্রতিষ্ঠিত শক্তিই প্রতিষ্ঠান। তার চরিত্র হলো জিজ্ঞাসাকে জাগিয়ে তোলা নয়, তাকে দাবিয়ে রাখা। যে কোনো স্বাধীন অভিব্যক্তির মুখ চেপে বন্ধ করা, অবশ্যই তা শ্রেণীস্বার্থে। স্বাধীনতা দেয়ার একটা ওপর ওপর ভান করলেও প্রতিষ্ঠান কখনোই তা পুরোপুরি দিতে পারে না এবং এই ভানটাও তার শ্রেণীস্বার্থেই। যখন কোন লেখকসত্তা প্রতিষ্ঠিত শক্তি বা তার ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলেন, বা আরো বেশি, তাকে পাল্টানোর জন্য মদদ যোগান তখন তার প্রতি সে ফিউরিয়াস হয়ে ওঠে। কোনো মানুষের নিরন্তর জিজ্ঞাসা ও তার নির্ভীক প্রকাশকে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। যখন কোন লেখক তাদের এই মানসিকতার কাছে পরিপূর্ণ বা আংশিক আত্মসমর্পণ করে বসে, তখন তাদের সে মাথায় তুলে নাচে, আসুরিক সামর্থ্যে তাদের জন্য বিজ্ঞাপন দেয় রেডিও-টিভি-সংবাদপত্র আর বিভিন্ন পুরস্কারের প্রচারে বিরাট লেখক বানিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি তাদের দিকে আকৃষ্ট করে।” এটাই বোধ করি সংবাদ সাহিত্যের ফ্যাক্টরিগুলোর লেখক পয়দা করার প্রচলিত প্রক্রিয়া।
লিটল ম্যাগাজিন এই প্রক্রিয়াটাকেই প্রতিহত করতে এগিয়ে আসে। তাই এ প্রসঙ্গে তপোধীর ভট্টাচার্যের মূল্যায়ন হলো- “এই জন্য লিটল ম্যাগাজিন নিছক ইতিহাসের উপকরণ মাত্র নয়, আসলে তা হলো ইতিহাসের নির্মাতা। বারবার আমাদের প্রচলিত অভ্যাসে হস্তক্ষেপ করে, এবং অনেকেক্ষেত্রে বেপরোয়া অন্তর্ঘাত করে, সাহিত্যের খাত থেকে পলি সরিয়ে দিয়ে তা তীব্র ও দ্যুতিময় নবীন জলধারাকে গতিময় করে তোলে। একই কারণে ছোট পত্রিকাকে বিশেষভাবে আত্মবিনির্মাণপন্থী না হলে চলে না। কেননা কখনো কখনো, নিজেরই সযত্নরচিত পদ্ধতি প্রকরণ ও অন্তর্বস্তু প্রাতিষ্ঠানিক স্বভাব অর্জন করে নেয় তখন নির্মোহভাবে নিজেকে আঘাত করে জটাজাল থেকে প্রাণের গল্পকে মুক্ত করতে হয়।”
“সাহিত্যের মূল্যবোধ আসলে সমাজের উঁচুতলার স্বার্থোপযোগী ও স্বার্থোনুমোদিত মূল্যবোধ। তাই ঐ মূল্যবোধকে তীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসার তীরে বিদ্ধ না করে, ঐ মূল্যবোধের আশ্রয় হিসেবে গড়ে ওঠা ভাষা-আকরণ-সন্দর্ভকে আক্রমণ না করে কোনো নতুন সম্ভাবনার জন্ম হতে পারে না।”
অতএব, যে ম্যাগাজিন পুরনো মূল্যবোধকে আক্রমণ করতে পারবে না তাকে আমরা প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিন বলতে পারি না। লিটল ম্যাগাজিনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে গিয়ে আরেক প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক সন্দীপ দত্ত তাঁর ‘লিটল ম্যাগাজিন ভাবনা’ গ্রন্থে ‘লিটল ম্যাগাজিন’ প্রবন্ধে যে বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করেছেন তা প্রণিধানযোগ্য-
১. যে কোন দেশ ও জাতির সাহিত্য সংস্কৃতির প্রধান ধারক ও বাহক সেই দেশের লিটল ম্যাগাজিনগুলি।
২. লিটল ম্যাগাজিনের অবস্থান ‘বিগ ম্যাগাজিনের’ ঠিক বিপরীতে।
৩. লিটল অর্থাৎ কম পুঁজিতে বৃহৎ চিন্তার প্রকাশ।
৪. লিটল ম্যাগাজিনের নিজস্ব লেখকগোষ্ঠী থাকে ও লেখক তৈরি করে।
৫. লিটল ম্যাগাজিন যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে।
৬. নিরপেক্ষ ও নির্ভীক বক্তব্য তুলে ধরে সমাজ ও সাহিত্য বিশ্লেষণ করে।
৭. লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে চালিত ও সংগঠিত করে।
৮. লিটল ম্যাগাজিনের উদ্দেশ্য সৃজনশীল সাহিত্যের প্রসার।
৯. লিটল ম্যাগাজিনকে বলা যায় তারুণ্যের সাহিত্য বা সাহিত্যের তারুণ্য।
১০. লিটল ম্যাগাজিনেই সাহিত্যের বহু কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে থাকে।
১১. লিটল ম্যাগাজিন যথার্থ অর্থে সাহসী পত্রিকা। যে কোন বক্তব্য (সাহিত্য-সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধ) প্রকাশে নিদ্বির্ধ। লেখার ব্যাপারে কোন রফা বা আপস করে না।
১২. প্রতিষ্ঠিত, বাজারী ও ব্যবসায়ী লেখক কিংবা লেখা ব্যবসায়ীর স্থান লিটল ম্যাগাজিনে নয়।
১৩. কাগজের বিশেষ চরিত্র গড়ে তোলা লিটল ম্যাগাজিনের অন্যতম শর্ত।
১৪. লিটল ম্যাগাজিন সমাজের কাছে দায়বদ্ধ।
১৫. লিটল ম্যাগাজিন বিশেষ উদ্দেশ্যবাহী।
১৬. লিটল ম্যাগাজিন যে কোন বিষয়ের হতে পারে। যথা- কবিতা, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, ধ্রুপদী সাহিত্য, শিল্পকলা, অনুবাদ, লোকসংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব, দর্শন, সমালোচনা ইত্যাদি।
১৭. লিটল ম্যাগাজিন সর্বাঙ্গীন সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক আন্দোলন।
১৮. লিটল ম্যাগাজিন যে কোন আয়তনের হতে পারে। নির্দিষ্ট কোন মাপ নেই। পৃষ্ঠাসংখ্যা ৩০০ হতে পারে, ১ পৃষ্ঠাও হতে পারে। তবে সাধারণভাবে ২ থেকে ৫-৬ ফর্মা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
১৯. ঝকঝকে, ঝকমকে গ্লামার না থাকলেও লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশরীতি ও রুচি মর্যাদাপূর্ণ।
২০. লিটল ম্যাগাজিনের অন্য প্রচেষ্টা- ‘নিজস্ব প্রকাশনা’।
২১. লিটল ম্যাগাজিনের দুটি দিক (১) সৃজনশীলতা (২) প্রতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির নিরপেক্ষ ও নির্ভীক প্রকাশ।
২২. নির্দিষ্ট পাঠক গড়ে তোলে। পাঠককে সাহিত্যের পাঠে দীক্ষিত করে নতুনভাবে।
২৩. সমসাময়িক ঘটনার স্রোতে লিটল ম্যাগাজিন উজ্জীবিত।
২৪. বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের প্রবণতা।
২৫. জাতীয় জীবনে কোন সাম্প্রতিক সমস্যা বা জ্বলন্ত বিষয় নিয়ে জনমত গড়ে তোলা।
২৬. আন্তর্জাতিক সাহিত্য, রাজনীতি, দর্শন প্রভৃতি বিষয়কে পত্রিকা মারফত প্রকাশ করা।
২৭. সাম্প্রতিক ঘটনাবলীকে স্পর্শ করা।
২৮. সাহিত্য সম্মেলনের নিয়মিত আয়োজন।
উপরোক্ত বিষয়গুলোই একটি আদর্শ লিটল ম্যাগাজিনের বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর নিরীখে আমরা অনায়াসে একটি ম্যাগাজিনের চারিত্র্য-বিশ্লেষণ করে আদৌ সেটা লিটল ম্যাগাজিন কি না তা যাচাই করে নিতে পারি। সবগুলো বৈশিষ্ট্যে যে সেটা সমুজ্জ্বল হতে হবে তা নয়। তবে অনিবার্য মৌলিক বৈশিষ্ট্য বাদ দিয়ে নিশ্চয় নয়। যে লক্ষ্যকে শিরোধার্য করে একটি লিটল ম্যাগাজিনের মূর্তিমান আত্মপ্রকাশ, সে লক্ষ্য অর্জনের মধ্য দিয়ে যেমন তার পরিক্রমা সম্পন্ন হয়, অন্যদিকে লক্ষ্যকে যথাযথ ধারণ করার ব্যর্থতাও তাকে দুর্ভাগ্যজনক অপমৃত্যুর চোরাবালিতে ঠেলে দিতে পারে। যেভাবেই হোক না কেন, দু’একটা ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সব লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রেই কেন জানি জন্মমাত্রই এরা স্বল্পায়ু হবার নিয়তিনির্দিষ্ট হয়ে যায়। পাঠক হিসেবে আমাদের প্রাপ্তিজনিত এই অতৃপ্ত মোহের আফসোসের জবাবও তাই বুদ্ধদেব বসুই দিয়ে যান আমাদেরকে-
“মনে হতে পারে আর্থিক কারণেই এসব পত্রিকা দীর্ঘজীবী হতে পারে না, কিন্তু সেটা শুধু আংশিক সত্য। স্বল্পায়ু হওয়াই এদের ধর্ম। বিশেষ কোনো সময়ে, বিশেষ কোনো ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর উদ্যমে, বিশেষ কোনো একটি কাজ নিয়ে এরা আসে, সেটুকু সম্পন্ন করে বিদায় নেয়। সেটাই শোভন, সেটাই যথোচিত।”
আহা, আমাদের জীবনটাও এরকম একেকটা চিহ্নময় লিটল ম্যাগের মতো হতে পারে না কি? শোভনসীমা পেরিয়ে গেলেও ক’জন বুঝি এটা! #
তথ্যসূত্রঃ
# বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিন চর্চা অতীত ও বর্তমান /সম্পাদক মিজান রহমান/কথাপ্রকাশ