নোয়াখালীঃ কল্পলোকের গল্পকথা (২)
পরশপাথর
১.
বাংলা সিনেমা আর বিটিভি’র কাছ থেকে আমি আপনি যতই মুখ ফিরিয়ে নিই না কেন গ্রামবাংলায় এগুলোর থেকে প্রভাবশালী মাধ্যম এখনও আরেকটি নেই। নোয়াখালীর রক্ষণশীল পরিবারগুলোতে খুব কমই মেয়েদের সুযোগ হয় বাড়ীর বাইরে গিয়ে পৃথিবীটাকে জানবার বা দেখবার। সাধারণ বাড়ীর মেয়েদের বিনোদন বলতে বাড়ীর ভিতরে ননদ ভাবীরা মিলে টেলিভিশান দেখা অথবা নিকট আত্মীয়ের বিয়েতে সবাই মিলে একসাথে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়া। গৃহস্থ ঘরের বউদের জন্য বড়জোর ছয় মাসে, নয় মাসে একবার বাপের বাড়িতে নাইওর যাওয়া। যাওয়ার মত তাদের আর তেমন কোন জায়গা খুঁজে পাওয়া কষ্টকর।
কিন্তু অগোচরে আরও একটি জায়গা যে বাকী থেকে যায়। বাবা-মা,আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন কেউই সে জায়গার খবর রাখতে পারেনা । তাদের নিজস্ব জায়গা, নিজস্ব পৃথিবী, নিজস্ব রাজ্য। একান্তই নিজের। বোধ করি, এ চিত্র শুধু নোয়াখালীর নয়,সমস্ত বাংলার। রক্ষণশীল বলি আর উদার বলি, যে কোনও ফ্যামিলির। চারদেয়ালের মাঝে বন্দী থেকেও এই একটা জায়গাতে এসে বাংলার মেয়েরা মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে যায়, স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে থাকে তাদের কল্পনার আকাশে। কেউ দেখেনা, কেউ জানেনা, কেউ বোঝেনা, কেউ শোনেনা। নিজের আপন ‘মন’ - একমাত্র জায়গা, যেখানে তারা নিজেদের লুকিয়ে রাখতে পারে মনের মত করে। আর এ জায়গাটাতেই এসে বাংলা সিনেমা পালন করে এক বিশেষ ভূমিকা। সেই ভুমিকা ইতিবাচক না নেতিবাচক সেটা বিচারের দায়িত্ব আমাদের নয়।
এখানে কিছুদিন পরপরই শোনা যায় অমুকের মেয়ে তমুক ছেলের সাথে চলে গেছে। চলে যাওয়া মানে পালিয়ে বিয়ে করতে যাওয়া। এ ব্যাপারটা এ অঞ্চলটাতে এত বেশি পরিমাণে প্রচলিত আর আলোচিত যে না বললেই নয়। ঘটনা মোটামুটি একই ধাঁচের। একদিন হঠাৎ দেখা গেল বাড়ির মেয়েটি বাড়ীতে নেই। পাশের বাড়ীর কোন এক মেজ কিংবা সেজ ভাবী ভোর বেলাতে সর্বশেষ তাকে বাড়ীর পশ্চিমধারে দেখেছে, হাতে অবশ্য একটা লাল ব্যাগও ছিল, বলবে বলবে করেও ভাবীটি কেন জানি শেষ পর্যন্ত কথাটা বলতে ভুলে গেছে। বলা বাহুল্য যে, এই ভাবীর সহযোগিতায়ই পালানোর সকল কর্ম সুসম্পন্ন হয়েছে। প্রেমিকের হাত ধরে পালানোর কারণতো সেই লাইলি-মজনুর আমল থেকে আজ পর্যন্ত একটাই, তথাকথিত অসম প্রেম। এক্ষেত্রে বাংলার মেয়েরা আজীবন চলচ্চিত্রগুলোতে দেখে এসেছে, ঐশ্বর্য আর আভিজাত্যের মোহে বাবা টাইপ লোকজন চিরদিন অন্ধ হয়ে থাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে পৃথিবীর সবকিছু তুচ্ছ জ্ঞান করে প্রেমিকের হাত ধরে অজানার উদ্দেশে পাড়ি দিতে হয়। নিজেকে নায়িকা বা নায়ক বানানোর এত বড় সুযোগ হাতছাড়া করার জন্য যে পরিমাণ ম্যাচুরিটি দরকার তা তাদের থাকেনা বলেই হয়তো সুযোগটাকে এরা কাজে লাগিয়ে ফেলে তড়িঘড়ি করে। জন্ম হয় এক সিনেমার, টান টান উত্তেজনায় ভরা নাটকের।
খবর জানার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ট্রয়ের যুদ্ধ । মেয়ের অভিভাবকদের প্রথম দায়িত্ব হয় মাইক্রোবাস ভাড়া করে যত দ্রুত সম্ভব কোর্ট এ চলে যাওয়া। বিয়ে আটকানোর প্রথম ধাপ। এটুকু বলা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, আমি থাকা অবস্থায় যে দুজন অজানায় পাড়ি জমিয়েছিল, তারা কোর্ট এর পথ ছেড়ে তাদের গতিপথ ঠিক একশ আশি ডিগ্রী পরিবর্তন করে যাত্রা শুরু করেছিলো একেবারেই উলটো দিকে। সমরনায়কদের রণকৌশল পরিবর্তন করার মত ব্যাপার। ইতিমধ্যে ঘটনাটি টক অভ দ্যা ভিলেজ। ছেলেটা হিরো। আর মেয়েটা আবহমান বাংলার ঐতিহ্য অনুযায়ী চরিত্রহীন। ছেলের বাবা নতুন পাঞ্জাবীটা গায়ে দিয়ে একবুক গর্ব বুকে নিয়ে কিন্তু দুঃখ দুঃখ ভাব করে বাজারে বের হয়ে আসেন, আন্যদিকে মেয়ের বাবা এক বুক কষ্ট বুকে চেপে বাজার ছেড়ে বাড়ীর ভিতরে গিয়ে মুখ লুকিয়ে থাকেন। সেই সময়টাতে, ‘অমুকের মেয়েটার স্বভাব ভালো ছিলোনা, আগেই দেখে বুঝা গিয়েছিলো এই মেয়েটা বংশের মুখে চুনকালি দেবে’ এরকমটা বলতে বলতে পাড়া প্রতিবেশীদের কর্মব্যস্ততা দ্বিগুণ পরিমাণ বেড়ে যায়। তাদের একঘেঁয়ে জীবনে এসমস্ত নাটকীয় ঘটনাগুলো আসে ঠিক যেন কর্মপ্রেরণা হয়ে।
ঘটনার শেষ দৃশ্যটাও খুব সোজাসাপ্টা। এখন মোবাইলের কল্যাণে তা আরো সহজ হয়ে গেছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই যখন সঙ্গে করে নেয়া টাকা ফুরিয়ে যেতে থাকে কিংবা অনুশোচনার জ্বালা তীব্র হয়ে উঠে, তখন মেয়ে বাবার কাছ ফোন করে বলবে, ‘সে ভালো আছে, কিন্তু প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভয়ে বাড়ীতে ফোন করছে না।’ কিছুক্ষণ বাবা মেয়ে দুজনই চুপ করে থাকবে, এরপর শুরু হবে কান্না। তারপর কী হবে সে ব্যাপারে কথা না বাড়িয়ে আমাদের স্বাভাবিক বিয়ে বাড়ীর দিকে পা বাড়ানোই ভালো।
২.
এখানকার মধ্যবিত্তশ্রেণীর বিয়েগুলোতে দেনমোহর কমপক্ষে দশলক্ষ বা তার কাছাকাছি। নতুন বউকে দেয়া হয় পাঁচ থেকে দশ ভরি স্বর্ণ। কোনো ব্যতিক্রম নেই। ধার করে হলেও বিয়ের দিন এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বিয়ের আগেই সেটা ঘোষণা করতে হবে। অপরদিকে, প্রবাসীদের হিসেব একটু আলাদা। এখানে আমেরিকান প্রবাসীদের পরিচয় কিন্তু একটাই, আমেরিকান। আমেরিকায় কে কি করে সেটা কেউ জানতে চায়না, প্রয়োজনও মনে করেনা। কিন্তু তাই বলে আমেরিকান প্রবাসীরাতো আর বসে থাকতে পারেনা। দেনমোহরের অঙ্ক দিয়ে তারা কাগজে কলমে প্রমাণ করে দেয়, কে কত বড় আমেরিকান। তাদের ছেলেমেয়েদের বিয়ের কাবিন নামার প্রতিটি পৃষ্ঠার মূল্য গিয়ে দাঁড়ায় হাজার হাজার ডলারে, একেবারেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ আর অর্থহীন সেই বাহুল্য।
প্রায় সমস্ত বিয়েতেই আইটেম হিসেবে থাকবে মুরগী, বড় মাছ ভাজা, ডিম-পোলাও, এবং অতি অবশ্যই মুগডাল, ছোট ছোট টুকরো করে কাটা আলু এবং মহিষের দধি। প্রতিটি বিয়েতে যোগান দেবার জন্য এ ব্যাপক পরিমাণ মহিষের দধি কোথা থেকে আসে তার কথা লিখছি একটু পরেই। প্রতিটি বিয়েতে থাকবে দু’তিনজন খাতিরদার। এদের কাজ হল, সবার কাছে গিয়ে গিয়ে বলা,’আপনি দেখি কিছুই খেতে পারছেন না, নেন আরেক চামচ মাংস নেন, এই বলে আপনার প্লেটে অনেকগুলো মাংস দিয়ে দেবে’। কোনভাবে যদি আপনি একজন খাতিরদারকে বুঝাতে পারেন যে, খাওয়ার মত আর তিল পরিমাণ জায়গাও আপনার পেটে অবশিষ্ট নাই। তাহলে উনি ব্যার্থতার ভার কাঁধে নিয়ে চলে যেতে থাকবেন। কিন্তু আপনার জন্য দুঃসংবাদ। এবার আসবে একজনের বদলে দু’জন খাতিরদার। সে যাই হোক, মাছ-মুরগি-ডিম এসবের কোনটিই কিন্তু স্ট্যাটাস মাপার মাপকাঠি নয়। বিয়েতে কয়টা গরু জবাই দেয়া হল সে সংখ্যাটাই হচ্ছে সর্বজনবিদিত মাপকাঠি। যে লোকটি ব্যস্ততার কারণে বিয়েতে উপস্থিত হতে পারেনি সেও বাড়ী ফিরে এসে জিজ্ঞেস করবে, কয়টা গরু জবাই করা হয়েছে? এজায়গাটাতে আরও একবার নিজেদেরকে প্রমাণ করার সুযোগ পেয়ে যায় প্রবাসীরা।
বিয়ে দেবার সময় হলে প্রবাসীরা বিয়ের উপযুক্ত ছেলে বা মেয়ে নিয়ে চলে আসেন এখানে। তারপর শুরু হয় পাত্র বা পাত্রী খোঁজা। সে এক আরব্য রজনীর রূপকথা। কাহিনীটা আরেকটু বড় করে আমাকে বলতে হবে অন্য সময়ে। সৌভাগ্যক্রমে, এরকম একজন ব্যাক্তির সাথে দেখা হবার সুযোগ আমার হয়েছিল, যিনি বিয়ে করেছেন একজন আমেরিকা প্রবাসীর কন্যাকে। দুইশত তেষট্টিজন ছেলে দেখার পর এই ভদ্রলোক নির্বাচিত হন পাত্র হিসেবে,পাত্রী নিজেই পছন্দ করেছেন। শোনার পর আমার ইচ্ছে হল ভদ্রলোকের একটা সাক্ষাৎকার নিয়ে বিবিসি, সিএনএন সহ পৃথিবীর সব প্রচার মাধ্যমে একযোগে প্রচার করা শুরু করি। পরিতৃপ্তির একটা হাসি দিয়ে তিনে আমাকে জানালেন, ইউ,এস,এ তে উনার একটা মেয়েও হয়েছে। আমার কাছে দোয়াও চাইলেন। আমি দোয়া করলাম একেবারে প্রাণভরে । দুইশত তেষট্টিজনকে পরাজিত করে যিনি চ্যম্পিয়ন হয়েছেন তার মেয়ের জন্য দোয়া করাটা আমার জন্য চরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।
বিয়েগুলো কতটা জমজমাট হল তার কিছুটা নির্ভর করে আশপাশের সব ইউনিয়ন থেকে ঠিক কতজন চেয়ারম্যান বিয়েতে উপস্থিত থাকলো তার উপর। চেয়ারম্যানসাহেবদের ছাড়া এখানকার বিয়ে কল্পনাই করা যায়না। সে সূত্র ধরেই এবার এখানকার একজন লিজেন্ডারী চেয়ারম্যানের কথা বলি। কথিত আছে যে, একদা কোন এক বিয়ে বাড়িতে গেলে লোকজন যখন বলছিল, ‘চেয়ারম্যান সাহেবের জন্য বোন্ প্লেট নিয়ে আসা হোক।‘ চেয়ারম্যান সাহেব না না করতে করতে বলেছিলেন, ‘ আনার কোনো দরকার নাই, বোন্ প্লেট আমি খাবনা।‘ আবার পনেরই অগাস্ট শোকদিবস উপলক্ষ্যে কোন এক প্রাইমারী স্কুলে শিশুদের জন্য বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ’একাত্তরের এই দিনে বঙ্গবন্ধুকে শেখমুজিব গুলি করে হত্যা করে ফেলেছিলো।‘ হয়তো সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘পঁচাত্তরের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবকে গুলি করে হত্যা করা হয়।’ কিন্তু গ্রাম বাংলার দামাল ছেলেরা ছাড়বে কেন? প্রাইমারী স্কুলের হলে কি হবে, রটনা রটাতে যে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট। তার উপর চেয়ারম্যান সাহেব স্থানীয় আওয়ামীলীগ অফিস এ গিয়ে বলেছেন, ‘ক্লাস টেন এর ছেলেরা আমার সাথে দুর্ব্যবহার করেছে।‘ প্রাইমারী স্কুল থেকে ক্লাস টেন এর স্টুডেন্ট কিভাবে বের হল সে চিন্তায় সেদিন লীগকর্মীরা দিশাহারা হয়ে গিয়েছিলো।
কিন্তু যে জন্য আমি তাঁর কথা বলছি সেটা একটু অন্য ধরনের। এতদিন গল্প উপন্যাসে শুনে এসেছি, অমুকের পূর্বপুরুষের এত এত সম্পত্তি ছিল যে একপাশ থেকে তাকালে আরেক পাশ দেখা যেত না। কিন্তু এই বাংলায় যে সেটা এখনো কারো থাকতে পারে সেটা এই চেয়ারম্যান সাহেবের পরিবারে সম্পত্তি না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বিস্তৃর্ণ সেই ভূমিতে যতদূর চোখ যায় সোনালী ধান আর ধান। দলে দলে কৃষক সে জমির ধান কাটছে। আছে ভেড়ার দল, আছে মহিষ, শত শত মহিষের পাল। এই সমস্ত ভূমির মালিকগোষ্ঠী আর তাদের মহিষগুলোই হচ্ছে বিয়ে বাড়িতে যোগান দেবার জন্য সেই দধির উৎস, যার কথা আমি বলেছিলাম বিয়ে বাড়ীর বর্ণনায়। কে জানে, এই সম্পত্তির পিছনেই হয়তো আছে তাদের পূর্বপুরুষদের চর দখলের কোনো রক্তাক্ত ইতিহাস। তার খবর আর নিতে যাবার আগ্রহ দেখাইনি। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে কে ভালবাসে?
৩.
প্রতিটি মানুষই যেন এখানে এক একটি মহাকাব্য। যত দূর্বল আর সাধারণই হোক না কেন তাদের কাহিনী; সেখানে ঘটনার ব্যাপ্তি আছে, বুদ্ধির দীপ্তি আছে। এবারে চরিত্রের নাম ধরেই বলি। ইউনুস মাঝি। না, দি ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সী টাইপ কিছু নয়। মাঝি হিসেবে তার কোন বীরত্বগাঁথা আছে নাকি সেরকম কোনো তথ্যও আমি পায়নি। এখানকার লোকজন বলেন ইন্নস মাঝি। বয়স্ক এই লোকটি যখন ঘর থেকে বের হন, তার স্ত্রী একটা পাটি বা পর্দা ধরে রাখেন তার মুখচোখের উপর। পর্দা ধরে তাকে বাড়ীর বাইরে নিয়ে দিয়ে আসা হয়। কারণ আর কিছুই নয়, তার বাড়ীর উঠোনে বিচরণ করতে থাকা মুরগীর বাচ্চাগুলোতে যেন কোনভাবেই তার চোখ না পড়ে। একবার চোখ পড়লেই শেষ। পরের দিন থেকে বাচ্চাগুলোর মরতে থাকবে একের পর এক। স্থানীয় লোকজন এটাকে বলে মুখ দেয়া বা মুখ লাগা। নজর লাগানোর এতো বড় উদাহরণ এই পুরো পৃথীবীতে আর কয়টা খুঁজে পাওয়া যাবে বা আদৌ পাওয়া যাবে কিনা সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ইন্নস মাঝি কোনো গৃহস্থবাড়ীর পাশ দিয়ে যাবার সময় বাড়ীর কর্তা ব্যক্তিটি মনে মনে যিকির করতে থাকেন, যাতে কোনভাবেই তার ক্ষেতের লাউগুলোর উপর কিংবা তার বাড়ীর উঠোনে শুকোতে থাকা ধানের স্তূপ এর উপর ইন্নস মাঝির চোখ না পড়ে।
কিন্তু যখনই ভাবছিলাম এরকম উদাহরণ কেবলমাত্র একটাই আছে ঠিক তখনই একজন বলে উঠলেন, এরকম আরেকজন আছে পাশের এলাকায়। ইন্নস মাঝি নাকি তার কাছে কিছুই না, একেবারে শিশু। ওই লোক দূর থেকে আম গাছের দিকে তাকিয়ে যদি বলে, ‘এ গাছে এবার অনেক আম ধরেছে’; পরের দিন থেকেই থোকায় থোকায় আম কালো হয়ে নীচে ঝরতে থাকে। গ্রাম বাংলার সহজসরল মানুষগুলোর তিলকে তাল বানিয়ে বলার স্বভাবটা আমার কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু তারপর যে পরিকল্পনার কথা আমি তাদের কাছে শুনলাম, সেটা গ্রামবাংলাতো দূরে থাক নাসার কোনও সায়ন্টিস্ট এর মাথায়ও আসবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। ‘এক গৃহস্থবাড়ীর পুকুর কচুরিপানাতে ভর্তি হয়ে গেছে। সমস্ত পুকুর পরিষ্কার করতে প্রচুর পরিমাণ লোক এবং খরচ দরকার হবে। অতএব তারা সিদ্ধান্ত নিলো যে মুখ (নজর) দিতে পারা লোকটিকে কোনভাবে পুকুরের ধারে নিয়ে আসতে হবে। তারপর যদি সে একবার বলে, “এই পুকুরে এত পানা কেন?” তাহলেই কর্ম সারা। পরের দিন থেকে পুকুরভর্তি কচুরিপানা শুকোতে শুরু করবে।’-একেতো মিথ্, তার উপর তাকে কাজে লাগিয়ে আবার অর্থ সাশ্রয়। আমার প্রায় পাগল হয়ে যাবার দশা।
তারপর কি ঘটনা হলো জিজ্ঞেস করে জানলাম, যথাসময়ে লোকটি এসেছিল এবং ওই বাড়ীর সমস্ত বাচ্চাকাচ্চাগুলো সেদিন গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো পুকুর ধারে। স্থানীয় ভাষায়, তামাশা দেখার জন্য। কিভাবে মুখ(নজর) দিতে হয় সেটা দেখার লোভ বাচ্চাগুলো সামলাবেইবা কি করে? কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতঃ ‘এ পুকুরে এত কচুরিপানা কেন’ না বলে মুখ(নজর) দিতে পারা লোকটি বলেছিলো,’ এ বাড়ীতে এত বাচ্চাকাচ্চা কেন?’ তারপরের ঘটনা বড়ই মর্মান্তিক। হাসব না দুঃখ পাব বুঝে উঠতে না পেরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম। পরের দিন ত্থেকে নাকি একে একে সব বাচ্চাগুলোর জ্বর উঠতে থাকে, আর একে একে মরে যেতে থাকে বাচ্চাগুলো।
যে লোকগুলো আমাকে কথাগুলো বলছিলো তাদের অবাক আর করুণমুখগুলোর দিকে তাকিয়ে সেদিন খুব ইচ্ছা করছিলো বিশ্বাস করে ফেলি কথাগুলো। ক্ষণিকের জন্য হয়ে যেতে ইচ্ছে করেছিলো তাদেরই মত একজন। কিছু কিছু মানুষ এই পৃথিবীতে কি করে এমন অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়, এটা তাদের কাছে এক অপার বিস্ময়। এ সহজ সরল মানুষগুলো অতি সহজেই অবাক হয়ে যায়। তারা জানতেও পারেনা যে, কচুরিপানাওলা সেই গৃহস্থবাড়ীর অস্তিত্ব কোনওকালেই তাদের সেখানে ছিলোনা। কেউই সে বাড়ি দেখেনি, শুধু শুনে এসেছে একজন আরেকজনের কাছ থেকে। তবু, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে তারা খুঁজতে চেষ্টা করে এই রহস্যের সত্যিকারের সমাধান। আমি মনে মনে খুঁজতে চেষ্টা করি, সর্বশেষ কবে এমন করে অবাক হতে পেরেছিলাম। মনে পড়ে না। মনে পড়বার কথাও নয়। আধুনিক এই যুগ অনেক আগেই আমাদের অবাক হতে পারবার ক্ষমতাটা কেড়ে নিয়েছে।
…
poroshpathor81@yahoo.com
January 29, 2008