জামায়াত কি এবারও পার পেয়ে যাবে
চিররঞ্জন সরকার

দেশের দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রথম সারির নেতারা দুর্নীতি ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতার হলেও জামায়াতে ইসলামীসহ মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। একদিকে গ্রেফতার এবং অন্যদিকে সংস্কার নিয়ে বিভক্তি-মতান্তরের কারণে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতিনিধি এ দুই রাজনৈতিক দল দুর্বল হওয়ার কারণে মৌলবাদী শক্তি হিসেবে পরিচিত জামায়াত সংহত হয়ে উঠছে। এতে দেশে অদূর ভবিষ্যতে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটতে পারে বলে আশংকা বেড়ে যাচ্ছে। আর কেবল আওয়ামী লীগ-বিএনপি বিপর্যয়ের সুফলই নয়, নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবিত বিধিবিধান কার্যকর হলেও অন্যসব ইসলামী দলগুলো নিজেদের গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হবে। শেষ পর্যন্ত এর সুফলও যোগ হবে জামায়াতের অনুকূলে। এর ফলে সরকারের নিরপেক্ষ ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রতিনিয়ত আশংকা ব্যক্ত করা হচ্ছে।

জামায়াতকে নিয়ে নানা প্রশ্ন

বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দেশ পরিচালনার ৬ মাস পূর্ণ হয়েছে। এই সময়কালে সরকারের সবচেয়ে সাহসী উদ্যোগ হচ্ছে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ। এ পর্যন্ত বিএনপির সিনিয়র যুগ্ন মহাসচিব তারেক রহমান এবং দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ প্রায় ৪০ জন সাবেক মন্ত্রী-এমপিকে নানা অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। একইভাবে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর, কাজী জাফরুল¬াহসহ আওয়ামী লীগেরও প্রায় সমসংখ্যক নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও এক প্রকার সংকুচিত জীবনযাপন করছেন। কিন্তু দেশের সবচেয়ে বড় মৌলবাদী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামীর তেমন কেউ গ্রেফতার হননি। তাদের বিরুদ্ধে সরকারের তেমন কোনো অভিযোগ আছে বলেও মনে হচ্ছে না। অথচ আমরা জানি, জামায়াতে ইসলামী বিগত ৫ বছর বিএনপির সঙ্গে জোট সরকারে ছিল। সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও দলীয়করণসহ বিভিন্ন অভিযোগ থেকে জামায়াতের মন্ত্রীরাও মুক্ত নন। ব¬ক সুপারভাইজার ও গাজীপুর কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল জামায়াতের আমির ও তৎকালীন কৃষি মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তখন নিজামীকে বাধ্য হয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। দলীয় নেতাদের এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুবিধা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে। কিন্তু তারপরও রহস্যজনক কারণে জামায়াত নেতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন। জামায়াত নেতাদের অর্থের উৎস বা সম্পদের হিসাবও খোঁজা হচ্ছে না।

বর্তমান সরকারের যাবতীয় শুদ্ধি অভিযান জামায়াতকে মাইনাস করেই পরিচালিত হচ্ছেÑ এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক মহল থেকে জোরেশোরেই উচ্চারিত হচ্ছে। এ অভিযোগের কারণও আছে। বর্তমান সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির। দেশে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বৃহৎ এ দলদুটি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। দুই দলের দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠছে। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুই দলেই সংস্কারবাদীরা তৎপর দুই নেত্রীকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিতে। এ নিয়ে দুটি দলই ভাঙনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। এক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থা বেশি নাজুক। কিন্তু জামায়াতের ডা. এটিএম তাহের ও মিজানুর রহমান চৌধুরীসহ দু’তিনজন মাঝারি মানের গ্রেফতার হলেও বড় নেতারা বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

জামায়াতসহ যুদ্ধাপরাধী ও মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার ঘটনাকে দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ রহস্যজনক হিসেবে অভিহিত করছেন। দেশের মতো বিদেশেও এ ঘটনা নিয়ে নানারকম খবর প্রকাশিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দৈনিক পত্রিকা দি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালও সম্প্রতি এ আশংকা প্রকাশ করেছে যে, বর্তমান সরকার শুধু বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ওপর টার্গেট করেছে। এ দুই দলের পরিবর্তে জামায়াত ও ধর্মভিত্তিক দলগুলো শূন্যস্থান পূরণ করবে। ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউর ডেপুটি এডিটর কুলাম মারফি ‘ডেমোক্রেটাইজিং ঢাকা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ আশংকা ব্যক্ত করেছেন।

শুধু তাই নয়, বিএনপির অধিকাংশ সচেতন নেতা-কর্মী মনে করেন, জামায়াতের অনেক নেতা-কর্মী বিএনপির মধ্যে লুকিয়ে আছেন। তারা নিজেদের বিএনপি কর্মী পরিচয় দিলেও তারা ভেতরে ভেতরে জামায়াতের স্বার্থরক্ষা করে থাকেন। দলের ওপর ভাগেও এদের অস্তিত্ব রয়েছে। এরা যখন সুবিধাজনক সময়ে আসল পরিচয়ে উপস্থিত হবেন, তখন আর বিএনপি নেতাদের কিছুই করার থাকবে না বলে তাদের ধারণা। অনেকের মতে, বিএনপি যতটা দুর্বল হবে, জামায়াত ততটা শক্তিশালী হবে।

প্রশাসনেও রয়েছে জামায়াতের শক্ত ভিত। গত সাড়ে পাঁচ বছরে জামায়াত সমর্থিত কর্মকর্তারা প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো কব্জা করেছেন। ক্ষমতার পালা বদলে বিএনপির সমর্থক কর্মকর্তারা কিছুটা বেকায়দায় পড়লেও জামায়াতপন্থিরা রয়েছেন নিরাপদ অবস্থানে। তারা তাদের শক্তিকে আরো সংহত করেছেন। ফলে সংস্কার ও দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ডের ঢেউ অন্য সবাইকে লণ্ডভণ্ড করলেও জামায়াতের ভিত্তিকে এতটুকু নাড়া দিতে পারে নি। বরং তারা আরো বেশি শক্তি সঞ্চয় করে অনেক বেশি সুবিধাজনক ও নিরাপদ অবস্থানে রয়েছে।

বরাবরই সুবিধাজনক অবস্থানে জামাত

পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ওপর ভয়াবহ সংকট নেমে এলেও জামায়াতের ওপর কখনোই তেমন কোনো বিপদ নেমে আসেনি। এই দলটি সব সময়ই কোনো না কোনো মহলের আশীর্বাদ পেয়ে আসছে। সংস্কারের নামে খালেদা-হাসিনা মাইনাস রাজনীতিতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ অনেকটা টালমাটাল অবস্থায় পড়লেও সুবিধাজনক অবস্থানে আছে জামায়াত। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, জামায়াত ১১ জানুয়ারির পর নতুন কোনো শক্তিকে আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করেছে বলেই সব ঝামেলার ঊর্ধ্বে আছে। রাজনীতির ঘূর্ণিঝড়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো টালমাটাল অবস্থায় পড়লেও জামায়াতের সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অথচ এই দলটি দেশের গণতন্ত্র ও স্থিতির জন্য সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। কারণ জামায়াতের গঠনতন্ত্রে বাংলাদেশের সংবিধান বিরোধী প্রতিশ্র“তি রয়েছে। কাজেই সব দলের আগে জামায়াতে সংস্কার হওয়া প্রয়োজন।

অবশ্য জামায়াতের এই সুবিধাজনক অবস্থায় উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অবদানও কম নয়। এই বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতালিপ্সা, অদূরদর্শিতা ও আদর্শহীনতার বিপরীতে জামায়াতের সুবিধাবাদী চরিত্র এদেশে রাজনৈতিকভাবে এই দলটিকে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছে। জামায়াত এর আগে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে ‘সফল’ হয়েছে। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে জামায়াত আন্দোলন করেছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে। ’৯১-এর পর বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে জামায়াত আন্দোলন করেছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একযোগে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে বিএনপির সঙ্গে এক মঞ্চে উঠে। ২০০১ সালের নির্বাচনে চার দলীয় জোটের ব্যানারে বিএনপি বিজয়ী হওয়ার পর সরকারে অংশগ্রহণ করেছে জামায়াত। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে কার্যকর সহযোগিতা দিয়েছে জামায়াত। কিন্তু ১১ জানুয়ারির পট পরিবর্তনের পর বিএনপির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একলা চলো নীতিতে নিরাপদে আছে জামায়াত।

বর্তমানেও ক্ষমতাসীন মহলের কোনো কোনো অংশের সঙ্গে তারা গাটছড়া বেধে ফেলেছে বলে নানা মহল থেকে অভিযোগ উঠছে। ফলে অন্য প্রধান দলের নেতারা না পারলেও জামায়াতে সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক জোট সরকারের মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ নির্বিঘেœ বিদেশ যেতে পেরেছেন। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা একাধিক মামলা বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে কোনো রকম বাধা না হলেও একই রকম অভিযোগের কারণে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রধান পদে খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা কতো বছর আছেন তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। কিন্তু জামায়াতের নেতৃত্বে মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ কতো বছর ধরে আছেন এবং গোলাম আজম কতো বছর ছিলেন তা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। উলে¬খ্য, অধ্যাপক গোলাম আজম পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জামায়াতের আমির ছিলেন ২২ বছর। মাওলানা নিজামী ও মুজাহিদ বর্তমান পদে আছেন সাত বছর ধরে।

জামায়াতের যে সব নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে

সমালোচনা কিংবা চক্ষুলজ্জার কারণেই কিনা, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানের প্রথমদিকে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেও বর্তমানে জামায়াতে অভিযুক্তদের নামের তালিকা আস্তে আস্তে দীর্ঘ হচ্ছে। ইতোমধ্যে মামলা হয়েছে জামায়াতের বেশ কজন নেতার বিরুদ্ধে।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে দলটির আমীর ও সাবেক কৃষি ও শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এছাড়াও ২৮ অক্টোবর পল্টনে ১৪ দলের সঙ্গে জামায়াতের সংঘর্ষে মামলায়ও নিজামীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়। এই মামলায় নিজামী ছাড়াও দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল¬া, জামায়াত নেতা এবং ইসলামি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ আব্দুল হান্নান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরুল ইসলাম, নায়েবে আমীর মকবুল আহমেদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মো. কামরুজ্জামান, এটিএম আজহারুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম খান, পল্টন থানা আমীর এটিএম সিরাজুল ইসলাম, ছাত্রশিবিরের সভাপতি শফিকুল ইসলাম মাসুদ, সেক্রেটারি জেনারেল জাহিদুর রহমান, ঢাবির সাবেক সভাপতি শিশির মনিরের বিরুদ্ধেও চার্জশিট দেয়া হয়েছে।

এদিকে কুমিল্লায় আলী আহসান মুজাহিদ এবং সিলেটে সাবেক সাংসদ মাওলানা ফরিদ উদ্দিনসহ জামায়াতের ৪ নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা হয়েছে। এছাড়াও দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি এবং সন্ত্রাসী মদদদানের অভিযোগে সাবেক সাংসদ ডা. সৈয়দ আব্দুল¬াহ মো. তাহের, সাতক্ষীরা-৫ আসনের সাবেক এমপি গাজী নজরুল ইসলামকে আটক করেছে যৌথবাহিনী। ত্রাণের টিন আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হয়েছে, সাবেক এমপি মাওলানা আব্দুস সোবহান, সাবেক এমপি মিয়া গোলাম পারওয়ার, মিজানুর রহমান চৌধুরী। দুর্নীতি দমন কমিশন প্রকাশিত দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত শীর্ষ ৫০ জনের তালিকায় স্থান পেয়েছেন সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী। খুলনা মহানগর জামায়াতে আমীর সাবেক এমপি গোলাম পারওয়ার ও তার ভাই স্থানীয় জামায়াত নেতা গোলাম কুদ্দুছের বিরুদ্ধে মিল দখল এবং ৩ কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ না করার অভিযোগে খানজাহান আলী থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এছাড়াও গত ৭ মে পিরোজপুর জেলা সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম শফিক এবং সিলেটে জামায়াতের স্থানীয় নেতা কাজী নাসিরকে চাঁদাবাজির অভিযোগে আটক করা হয়েছে। তবে গত আড়াই যুগ ধরে জামায়াত দেশে যেভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে আর্থিক ও সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, ধর্মের নামে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাজনৈতিক ও আর্থিক ফায়দা তুলেছে, সে তুলনায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং ব্যবস্থাকে নিতান্ত অপ্রতুলই বলতে হবে।

জামায়াতকে ছাড় দিয়ে গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ করা যাবে না

জামায়াতের ইতিহাস যুদ্ধাপরাধের ইতিহাস, রগ কাটা-চোখ তোলার ইতিহাস। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ নিজেও জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের কথা উলে¬খ করেছেন। জঙ্গিবাদের সঙ্গেও জামায়াতের নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিগত জোট সরকারের সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের অপরাধে একটি অংশকে ধরা হবে আরেকটি অংশকে ধরা হবে না তা হয় না। জামায়াতকে ছাড় দিয়ে সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ করা যাবে না। কেননা জামায়াত কখনোই সুস্থধারার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। আর সুস্থধারার রাজনীতি না থাকলে মৌলবাদ বা জঙ্গিবাদের মতো রাজনীতি শক্তিশালী হবেই।

গত জোট সরকারের দুজন মন্ত্রী কেবল নয়, সরকার পরিচলনায় বিএনপির প্রধান সহযোগী ছিল জামায়াত। কাজেই জোট সরকারের সব অনিয়মের জন্য বিএনপির মতো জামায়াত সমান দোষে দোষী। বিএনপির সঙ্গে জোট সরকারে থেকে শুধু দুর্নীতি, দুঃশাসন আর জঙ্গিবাদের সঙ্গেই অংশীদার থাকেনি জামায়াত, তাদের অতীত ইতিহাসও দেখতে হবে। জঙ্গিবাদী হিসেবে যারা ধরা পড়েছেন তাদের অনেকেই এক সময় জামায়াতের সদস্য ছিলেন। ফলে সাধারণের মধ্যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে, জামায়াত জঙ্গিবাদকে মদদ দিয়েছে। জামায়াতের রাজনৈতিক ঘোষণার সঙ্গেও জঙ্গিদের ঘোষণার মিল আছে।

সব দলের আগে জামায়াতের গঠনতন্ত্রের সংস্কার হওয়া প্রয়োজন। কারণ এতে বলা আছে, ক্ষমতায় গেলে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করা হবে, যেটা বাংলাদেশের সংবিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন।

ইতিহাস ও মানবতার দায় বনাম জামায়াতের যুদ্ধাপরাধ

সেনাবাহিনী প্রধান মইন উ আহমদ এ বছর ২৭ মার্চে স্বাধীনতা দিবসের এক অনুষ্ঠানে জাতির পিতা প্রশ্নটির এতোদিনেও ফয়সালা না হওয়া এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি তুলে সুধীমহলে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিলেন। দেশবাসীর প্রশংসাও পেয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ দুটি সম্পর্কে আর কোনো আলোচনা বা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা শোনা যায় নি। আশা করা গিয়েছিল উপদেষ্টামণ্ডলী এ বিষয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দুটি গুরুত্বপূর্ণ অমীমাংসিত বিষয়ে একটি যৌক্তিক পরিণতির দিকে যাবেন। কিন্তু সরকারের দিক থেকে এখনো পর্যন্ত এব্যাপারে কোনো উদ্যোগ বা তৎপরতা চোখে পড়ছে না। এদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকর যে প্রক্রিয়া নির্বাচন কমিশন বিধিতে এ ব্যাপারে বিধিনিষেধ বা শর্তারোপ করা Ñতারও আলামৎ চোখে পড়ছে না। নির্বাচন কমিশন সংস্কার কিংবা রাজনৈতিক দল নিবন্ধীকরণের ব্যাপারে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার কোনো প্রস্তাব এখনো পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট মহল থেকে উত্থাপন করা হয়নি।

তবে যুদ্ধাপরাধীদের ঘাতক-জল¬াদদের ব্যাপারে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, কাদের মোল¬ার মতো পাকিস্তানি ‘কসাই’দের স্থান কোনো গণতান্ত্রিক এবং সভ্য দেশে হতে পারে না। গোলাম আযমতো পাকিস্তানিদের সঙ্গেই বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিল, তাকেই আবার ডেকে এনে নাগরিকত্ব দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে। সেই পুরস্কার এবং পুনর্বাসনের প্রক্রিয়ায় তারা আজ দেশের সংবিধানকে চ্যালেঞ্জ জানানোর ঔদ্ধত্য দেখানোর শক্তি ও সাহস অর্জন করেছে। ছদ্মবেশি জঙ্গিবাদের মাধ্যমে নিজেদের শক্তির প্রকাশও ঘটাচ্ছে।

মনে রাখতে হবে যে, পৃথিবীর ঘৃণ্যতম অপরাধ হচ্ছে যুদ্ধাপরাধ। জামায়াত সেই যুদ্ধাপরাধে অভিযোগে অভিযুক্ত। যুদ্ধাপরাধীরা কিন্তু দুর্নীতিপরায়ণও বটে। এই ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীরা ধর্মের নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণধর্ষণ ও গণহত্যাকে সমর্থন করে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করেছে। তাদের অপরাধের বিচার করা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই জরুরি। বর্তমান সরকারকে রাজনীতির সংস্কার করতে হলে প্রথমেই ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। না হলে মইন উ আহমদ বর্ণিত ‘ডিরেইলড ট্রেন’টি ক্রেন দিয়ে টেনে তোলা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। বর্তমান সরকারকে কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে তারা বস্তুতই আগমন বার্তার সদোচ্চারণে আস্থাশীল। যুদ্ধাপরাধ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াত যেন কিছুতেই ছাড় না পায়।

ঢাকা, ২৪ জুলাই ২০০৭
chiroranjan@gmail.com