মানুষ এখনো বিবর্তনের গতিপথেই রয়েছে
বিপাশা চক্রবর্তী
ছোটবেলায় টিভিতে হলিউডের একটি মুভি দেখেছিলাম। সেখানে মুখ্য চরিত্রে ছিল একটি শিম্পাঞ্জি। অবাক হয়ে দেখলাম শিম্পাঞ্জিটি অনেকটা মানুষের মতোই কি বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয়ই না করল! তখনো জানতাম না শিম্পাঞ্জির সঙ্গে মানুষের ডিএনএগত মিল প্রায় ৯৮.৮ ভাগ। যারা বিবর্তনবাদ সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা রাখেন তাদের কাছে ব্যাপারটি খুব স্বাভাবিক। যদিও আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোর কোথাও বিবর্তনবাদ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। কিন্তু আমাদের শিক্ষিত সমাজের অনেক ছাত্রছাত্রী যারা পড়ছেন এবং যেসব শিক্ষক, পড়াচ্ছেন তাদের মতো অনেক সচেতন ব্যক্তিই বিবর্তন সম্পর্কে খুব ঝাপসা ধারণা রাখেন, এমনকি অনেকে তো মানতেই চান না। অথচ তারা জানেন না প্রাণীকুলসহ মানুষের জীবন ধারণের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিবর্তন কীভাবে রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে। বিষয়টি যতটা স্পর্শকাতর মনে করা হয়, আসলে ততটা স্পর্শকাতর নয়। একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লে ও জানার চেষ্টা করলে সহজেই বিবর্তন সম্পর্কে একটি সঠিক চিত্র পাওয়া যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পড়াশোনা করব কীভাবে? জানবইবা কী করে? আমাদের দেশে বিবর্তন সম্পর্কীয় ভালো বইয়ের সংখ্যা খুবই কম (এর মধ্যে প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মার পূর্ব-প্রকাশিত কয়েকটি বই ছাড়া প্রায় নেই বললেই চলে)।
তবে আশার কথা এই, এ বছর একুশে বইমেলায় অবসর প্রকাশনা কর্তৃক প্রকাশিত বন্যা আহমেদের ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ উল্লেখযোগ্য একটি বই। বিবর্তনবাদ সম্পর্কে খুব সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় ২৩৯ পৃষ্ঠার এই বইয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বইটির ভূমিকায় বিখ্যাত বিবর্তনবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড.ম. আখতারুজ্জামান বলেছেন,‘জীববিজ্ঞানের সব শাখার ভিত্তিমূল হিসেবে বিবেচিত আধুনিক বিজ্ঞানের প্রত্যয়টির নাম বিবর্তনবাদ; আমার বিশ্বাস সেটি বাংলাদেশের মানুষদের কাছে সহজবোধভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হবে বন্যা আহমেদের বিবর্তনের পথ ধরে বইটি।’ প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মাও এই বই সম্পর্কে বলেছেন, ‘নতুন প্রজন্ম বিবর্তনবাদ নিয়ে সুবিস্তৃতভাবে লেখালেখি করছেন এটা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে।’
বইয়ের আলোচনায় প্রথমেই শুরু করা হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার ছোট দ্বীপ ফ্লোরন্সে বামন মানুষদের গল্প দিয়ে। প্রথমে রূপকথা মনে হলেও পরে আবিষ্কৃত হয় বাস্তব সত্যের। দেখা মিলে মানুষের নতুন আরেকটি প্রজাতির হবিট, যা কি-না বইটি পড়ার আগ্রহ আরো বাড়িয়ে তুলবে আগ্রহী পাঠকের। ধীরে ধীরে পৃথিবীর প্রায় সব প্রাণের বিবর্তনকে এই বইয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। সেই কবে ১৮৫৮ সালে ডারউইন বিবর্তন সম্পর্কে মতবাদ দিয়ে গেছেন, তা নিয়ে কেন এখনো মাতামাতি হচ্ছে? কেন আমাদের সমাজের সব স্তরের মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে জ্ঞান থাকা উচিত? কীভাবে একটি একক সরল প্রাণ থেকে শত শত বৈচিত্র্যময় প্রজাতির উদ্ভব ঘটল? কেন আমাদের চারপাশের বিভিল্পু প্রজাতির মধ্যে এত পার্থক্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক সাদৃশ্য - এ রকম অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে বইটিতে। শুধু তাই নয়, এখন পর্যন্ত পাওয়া সব আধুনিক তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে বইটিতে। আরো আছে সচিত্র বর্ণনা। তাছাড়া সম্প্রতিককালে নয়া সষ্টিতত্ত্ব ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন (আইডি), যা কি-না সরাসরি বিবর্তনবাদকে বিরোধিতা করে, এ ব্যাপারেও লেখক এখানে সাহসী আলোচনা করেছেন।
‘বিবর্তনের পথ ধরে’ বইটি যে শুধু বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের জন্য তা নয়; বরং বিজ্ঞানমনস্ক এবং বিবর্তনবাদে আগ্রহী সবার জন্যই এটি প্রয়োজনীয় বই। যাদের বিবর্তন সম্পর্কে ভাসাভাসা ধারণা আছে কিংবা নেতিবাচক মনোভাব আছে, বইটি পড়লে তাদের কাছে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
আজকের আধুনিক জীববিজ্ঞানের মহৃল ভিত্তিই হচ্ছে বিবর্তনবাদ অথচ আমাদের শিক্ষাত্রক্রমে জীববিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় বিবর্তন খুবই সংকুচিতভাবে পড়ানো হয়। ফলে সারাবিশ্বের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে পারছি না, পিছিয়ে পড়ছে দেশ। সেই মধ্যযুগীয় শৃগ্ধখলে আবদ্ধ থাকতে হচ্ছে বর্তমান প্রজন্মকে। বইটি পড়ে আরো বুঝতে পারলাম, মানুষ এখনো বিবর্তনের গতি পথেই রয়েছে। আধুনিক মানুষ লাখো-কোটি বিবর্তনের ফসল, যারা কি-না এখনো বিবর্তিত হয়ে চলেছে এবং মস্তিষ্ফে‹র বিবর্তনের মাধ্যমে আরো উল্পুত হয়ে মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে আগামীর পথে।
প্রসঙ্গত্রক্রমেই হয়তো অবসর প্রকাশনা কর্তৃক প্রকাশিত বইটিতে একই কথা বারবার বলতে হয়েছে। তাতে আগ্রহী পাঠকরা বিরক্ত হবেন না। কিছু ক্ষেত্রে প্রসঙ্গচ্যুতি ঘটেছে। তবে বিজ্ঞানের বই হওয়ায় সহজভাবে ব্যাখ্যার জন্য এক বিষয়ের সঙ্গে জড়িত অন্য আরেকটি বিষয় ব্যাখ্যা করতে হয়েছে। লেখক বন্যা আহমেদ বাংলা ভাষায় বিবর্তন সম্পর্কীয় এ বইটি লিখে সত্যিই প্রশংসাযোগ্য হয়েছেন।===============================================================
দৈনিক সমকালের কালস্রোত বিভাগে ২৭ এ জুলাই, ২০০৭ এ প্রকাশিত