সবকিছু নষ্টদের অধিকারে চলে যাবে

অভিজি রায়

 

আমি খুব সহজে আশাহত হই না।  “আশা নিয়ে ঘর করি, আশায় পকেট ভরি” টাইপের মানুষ আমি।  যখন সবাই হাল ছেড়ে দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে, তখনো আমি নির্ঘুম রাত জেগে থাকি এক চিলতে সোনালী রোদ্দুরের আশায়।  মনে মনে হয়ত আউরাই – ‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে’। আমার গাড়িতে একটা সিডি রেখে দিয়েছি, মাহমুদুজ্জামান বাবুর। অফিস যেতে যেতে প্রতিদিন সকালেই শুনতে থাকি  অফিস যাওয়ার পথটুকুতে – 

‘ভোর হয়নি, আজ হল না
কাল হবে কিনা তাও জানা নেই
পরশু ভোর আসবেই
এই আশাবাদ তুমি ভুল না’।

 হ্যা আশাবাদ আমি ভুলি না।  পরশুর ভোরের প্রত্যাশা করি। কিন্তু আমার মতন এই যে চরম আশাবাদী এ মানুষটিও গত কয়েকদিনে বাংলাদেশের গতিপ্রকৃতি দেখে যেন আশা হারিয়ে ফেলতে চাইছে।  আজ আর কালকের দুর্দৈব দেখে পরশু ভোর নয়, যেন অপেক্ষা করছি ঘোর অমানিষার।  অথচ ঘটনার শুরু হয়েছিল সামান্য একটা কৌতুকাশ্রিত কার্টুনকে কেন্দ্র করে। এমন একটা কৌতুক যা সম্ভবত শতাব্দী প্রাচীন। এমনই সাধারণ যা কিনা শিবিররাও তাদের কিশোর পত্রিকায় দেদারসে ব্যবহার করেছে।  কিন্তু সেই কৌতুকই কাল হল। আমাদের মতি মামার কাপুরোষোচিত বদান্যতায়  এক বিশ  বছর বয়সী তরুণ কার্টুনিস্টের জেল হল, আর আলপিন সম্পাদকের গেল চাকরী। আমি এ নিয়ে ক’দিন আগেই একটা লেখা লিখেছিলাম – যে দেশে শস্যের চেয়ে টুপি বেশি।  

আমি ভেবেছিলাম সময়ের সাথে সাথে টুপিওয়ালাদের দৌরাত্ম অচীরেই কমে আসবে। আশা ছিল গণমানুষের সচেতনতার প্রতি। ভেবেছিলাম গণমানুষ নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলে আর আইন-শৃংখলারক্ষাকারী বাহিনী একটু টাইট দিলেই আবার সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিন্তু এরপরের কয়েকদিনে যা হল, তা আমার কল্পণাকেও হার মানালো।  দেখলাম ব্যারিস্টার মইনুল সহ অন্য উপদেষ্টারা মোল্লা মহিউদ্দিন আর ওবায়দুল্লাহর সাথে গলাগলি করে দেশের আর ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র খুঁজতে লেগেছেন। ওই যুগল-সর্পিল কোল দিয়ে, বুক দিয়ে দেশ আর ধর্মের ভাবমূর্তি রক্ষা করার পণ করে নেমেছেন।  আর্মি আর মোল্লা যখন “স্ট্রেঞ্জ বেডফেলো’তে পরিণত হয় –তা হয় এক অতি কুসি দৃশ্য।  শকুন আর শৃগালের শয্যাদৃশ্য যেন এটি।  তাও না হয় সহ্য করলাম। তখনো আশা হারাইনি।

 

এর পরদিন দেখলাম সব বাঘা বাঘা সাংবাদিকেরা – যাদের কলমের আঘাতে এতদিন আকাশ বিদীর্ণ হয়, ধরিত্রী চৌচির হয়ে যায় বলে ভাবতাম – তারা হাতজোড় করে, নতজানু হয়ে কতগুলো অর্ধশিক্ষিত হুজুরের পালের (সরি, বলা উচি বিশিষ্ট আলেম সমাজ) কাছে ক্ষমাভিক্ষা করছেন। তখনো আমি আশায় বুক বেধে আছি।  এর মধ্যে আবার সাপ্তাহিক ২০০০ এর ঈদ-সংখ্যা বাজেয়াপ্ত হল।  কবি দাউদ হায়দার তার একটি আত্মজীবনীমূলক লেখায় মক্কার উপমা দিয়েছিলেন। এ ধরণের উপমা সাহিত্যে হরহামেশাই দেওয়া হয়।  লর্ডসকে ক্রিকেটের মক্কা বলে। আমরা কথায় কথায় বলি মক্কার মানুষ হজ পায় না, ইত্যাদি। আমি নিজেও সিঙ্গাপুরের বাঙ্গালীদের নিয়ে একসময় লিখতে গিয়ে আমার একটা লেখায় লিটল ইন্ডিয়া জায়গাটাকে সৌদি আরবের মক্কার সাথে তুলনা করেছিলাম। লেখাটি জনকন্ঠ আর ভোরের কাগজে ছাপাও হয়েছিল। আমার কখনো মনে হয়নি কারো কোন অনূভুতিকে আমি আঘাত করছি। 

‘মক্কা’ শব্দটি বর্তমানে সাহিত্যের এক অনিন্দসুন্দর উপমায় পরিণত হয়েছে, যেমনি ইংরেজী ভাষায় হয়েছে ‘বাইবেল’ শব্দটি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার স্যারেরা প্রায়-ই বলতেন অমুক বইটা বাঈবেল অব ফিসিক্স, কিংবা অমুক বইটা গনিতের বাইবেল।  যে কোন প্রোগ্রামার  কম্পিউটারের বইয়ের দোকানে গিয়ে বুকশেলফে খুঁজলেই পাবেন – “জাভা, এক্স-এম এল ওয়েব সার্ভিসেস – বাইবেল বুকস’, কিংবা ‘ জে.টু.ই.ই – বাইবেল বুকস’ ইত্যাদি। শুধু  প্রোগ্রামিং এর নিরস  বই নয়, খুঁজলে বাইবেল টাইটেল সমৃদ্ধ সরস বইও পাওয়া যাবে : The Sex Bible: The Complete Guide to Sexual Love (by Susan Crain Bakos) কিংবা The Wine Bible: Books (by Karen MacNeil) এমনকি The Brothel Bible: The Cathouse Experience এর মত বই।    কারো মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে না।  কারণ সবাই জানে বাইবেল এখানে আক্ষরিক ‘বাইবেল’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে না – বরং  এখানে বাইবেল-এর প্রয়োগ হচ্ছে ‘এন্সাইক্লোপিডিয়া’ কিংবা ‘সমগ্র’ হিসেবে। নিরেট মুর্খ ছারা কেউ  ‘ওয়াইন-বাইবেল’ বা ‘ব্রোথল বাইবেল’কে বাইবেলের অপমান  হিসেবে নেয় না, অথচ দাউদ হায়দারের লেখায় লৌক্ষ্মের বালাখানার পাশে মক্কার উপমা দেখে আমাদের ধার্মিক শিশ্ন খাড়া হয়ে ওঠে।   অবশ্য যে জাতির পন্ডিতদের নিছক বিড়ালের আগে মোহম্মদ দেখলেই শিশ্ন দিয়ে লাভার উদ্গীরণ ঘটে, সে জাতির ধর্মরক্ষকেরা লৌক্ষ্মের বালাখানার পাশে মক্কা দেখলে কি করবে তা সহজেই আনুমেয়।  আমার আগের ‘যে দেশে শস্যের চেয়ে টুপি বেশি’ প্রকাশের পর এক পাঠক একটি মন্তব্য করেছেন, যা উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারলাম না:

 

“বাঙালি মুসলমানের দুইটা মাত্র অনুভূতি খুব পোক্তা, একটা যৌনানুভূতি, আরেকটা ধর্মানুভূতিতবে যৌনানুভূতিটা প্রখর হলেও জানপ্রাণ দিয়ে ওটা আড়াল করে রাখে, আর ধর্মানুভূতিটা ভোঁতা হলেও ছুঁতা পেলেই ওটার উকট প্রকাশ ঘটায়।"

 

সাপ্তাহিক ২০০০ ঈদ সংখ্যার বাজেয়াপ্ত করণে উপরের উক্তির যথার্থতা প্রমাণিত হল মাত্র। এখন থেকে মনে হয় অর্ধশিক্ষিত মোল্লা ওমরদের কাছ থেকে কবি সাহিত্যিকদের সাহিত্য রচনায় শব্দ-প্রয়োগের তালিম নিতে হবে, আর তারপর লেখালিখি শুরু করতে হবে। তারপর-ও আমি বলব - আশার ঢোল ফুটো হয়ে গেলেও  তখনো আশা পুরোপুরি হারাইনি।

 

 

কিন্তু কাল যে ঘটনা পেপারে পড়লাম তার পর আশা রাখাটিই বোধ হয় এখন দুরাশা মাত্র। বায়তুল মোকারমের বৈঠক খানায় গিয়ে  বাংলাদেশের হেড মোল্লা খতিব ওবায়দুল হকের দলবলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এসেছেন চার সাংবাদিক আর দুই উপদেষ্টাপ্রথম আলোতে প্রকাশিত ছবিতে দেখলাম মোল্লা ওবায়দুল দলবল নিয়ে আয়েশে সফায় আসীন আর আসামী সাংবাদিক আর দুই উপদেষ্টা কাচু মাচু মুখে কাঠের চেয়ারে।  আসামী মতি হাত কচলাতে কচলাতে বার বার-ই হুজুরের কাছে ক্ষমা চেয়ে গেলেন এই বলে – “ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা যে-ভুল করেছি, তার জন্য দুবার ক্ষমা প্রার্থনা করেছিআজ আবারও ক্ষমাপ্রার্থনা করা হবেআমরা সচেষ্ট থাকব যেন এ ধরনের ভুলের আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে” আর শেষ মেষ মোল্লা ওবায়েদ  মহাপুরুষ সেজে মতিকে মাফ করে দিলেন এই বলে –“আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার পর নবী করিম (সা.)-এর উসওয়া এবং সুন্নত হলো এটাকে মাফ করে দেওয়া” 

এই রংগ-নাটক সাফল্যজনকভাবে মঞ্চায়ন করে বাংলাদেশ সরকার দুটো দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।  এক, সরকারীভাবে হেড মোল্লা ওবায়দুল হকের রাজনৈতিক ক্ষমতা মেনে নেওয়া হল। ইরানে যেমন একসময় খোমেনি কিংবা আফগানিস্তানে যেমন একসময় মোল্লা ওমরের তাগুদি নির্দেশে দেশ চলত, ঠিক তেমনি বাংলাদেশেও ফ্যানাটিক ওবায়দুল হকের সবক নিয়ে এখন থেকে বাংলাদেশ চলবে।  রাষ্ট্রের কর্ণধরেরা, উপদেষ্টারা, রাজনীতিবিদেরা, সাংবাদিকেরা সব একযোগে উবু হয়ে হেডমোল্লার পায়ের কাছে বসবেন, কেউ কেউ হয়ত অতি উসাহী হয়ে হুজুরের হস্ত-পদ ধৌত করবেন,  আর হুজুরে আলমপনা আশীর্বাদের ভঙ্গিতে সবক দিবেন, পবিত্র গ্রন্থ থেকে দিকনির্দেশনা দিবেন, আর সেই পবিত্র সবক মাথায় নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। 

আরেকটা দ্বিতীয় নজির-ও সেই সাথে স্থাপিত হল। এতদিন রাষ্ট্রীয় বিবাদ-বিপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সংসদভবন, বঙ্গভবন এগুলো ছিল উপযুক্ত এবং নির্বাচিত স্থান। আমাদের অতি বুদ্ধিমান রাষ্ট্রের কর্ণধরেরা সেটিকে সংসদভবনের বদলে বায়তুল মোকারমের বৈঠকখানায় নিয়ে ঊঠালেন। এই কাজের সুদূর-প্রসারী প্রভাব কি তারা ভেবে দেখেছেন? এ ব্যাপার-স্যাপারগুলো হয় শারিয়া-কেন্দ্রিক রাষ্ট্রে।  বাংলাদেশে শারিয়াভিত্তিক দেশে পরিণত হতে আর কয়েক পা দূরে রয়েছে বলে মনে হয়।  শারিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হলে তার আবস্থা কি হবে তা সম্বন্ধে আমাদের দেশের বিদ্যাবাগীশদের কোন ধারণা আছে?  আদালতে যেতে হবে না, স্রেফ মুখের কথাতেই স্ত্রীকে তালাক দেওয়া যাবে, তা সে গাঁজা খেয়েই হোক আর সুস্থ মাথাতেই হোক, কিন্তু স্ত্রী স্বামীকে কোন অবস্থাতেই তালাক দিতে পারবে না (Shafi’i Law # N 3.5, p.560; Hanafi Law, p.81, 523; Deen Ki Bnate, Maolana Ashraf Ali, Thanvi, p.254, Law 1537), মেয়েদের ধর্ষন প্রমাণের জন্য চারজন পুরুষ সাক্ষী লাগবে (Shafi’i Law # 0.24.9),  হিলা বিয়ের মাধ্যমে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে ঘরে তুলতে হবে (Islamic Laws by Ayatollah Seestani, Law # 2536, p.469; Hanafi Law, p.15; Shafi’i Law #p.29.1, p.673), হুদুদ মামলাতে মেয়েদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না  (Hanafi Law, p.353; Shafi’i Law # 0.24.9, p.638; Penal Law of Islam, p.44,45.), সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার থাকবে পুরুষের অর্ধেক (Abdur Rahman Doi, p.299) ইত্যাদি।  আমাদের রথী-মহারথীরা কি একবারো চিন্তা করেছেন দেশটাকে কোন চুলায় তারা নিয়ে যাচ্ছেন? 

 

তর্ক করার সময় আমি নিজেই বলি আমাদের একাত্তুরের মত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে, এ দেশ কখনোই শারিয়া ভিত্তিক দেশে পরিণত হবে না।  কালকেও এক বন্ধুর সাথে কথা বলতে গিয়ে একাত্তরের, নব্বই-এর উদাহরণ হাজির করলাম।  কিন্তু দেখলাম নিজের কাছেই নিজের কন্ঠ এখন অপরিচিত লাগছে। আমাদের জীবনে সত্যই কি কখনো একাত্তুর ঘটেছিল? কেমন যেন স্বপ্নের মত মনে হয় সবকিছু। বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবলে এখন সবার আগে চোখের সামনে ভেসে উঠে ইরাণে আর আফগানিস্তানের মত রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করা শশ্রুমন্ডিত জিহাদী বাহিনীর অগণিত মুখ।  বাংলাদেশ কি ওই দিকেই চলেছে? অথচ, আমার সিডিতে এখনও বেজে চলেছে মাহমুদুজ্জামান বাবুর সুললিত কন্ঠের গান –

 

‘ভোর হয়নি, আজ হল না
কাল হবে কিনা তাও জানা নেই
পরশু ভোর আসবেই
এই আশাবাদ তুমি ভুল না’।

 

২২ সেপ্টেম্বর ২০০৭

 

 


ড. অভিজি রায়, মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক; ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ ও ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক ইমেইল : charbak_bd@yahoo.com