কোরানের ‘মিরাকল ১৯’-এর উনিশ-বিশ!
সৈকত চৌধুরী এবং অনন্ত বিজয় দাশ
লেখাটি পিডিএফ আকারে পড়তে চাইলে দেখুন এখানে
‘মিরাকল’ (miracle) বা অলৌকিকতা সম্পর্কে আমাদের দেশের প্রত্যেকেই কম-বেশি অবগত আছেন। মিরাকল বলতে অনেকেই বুঝে থাকেন ধর্মের সাথে সম্পর্কিত বিষয়কে, যেমন স্রষ্টার অস্তিত্ব, স্রষ্টার কুদরতি শক্তি, স্রষ্টার যা ইচ্ছে তাই করার মতা, স্বর্গ-নরকের ধারণা, আত্মার ধারণা, মৃত্যুর পরের পারলৌকিক জীবন, পুরুষ্কার অথবা শাস্তির ব্যবস্থা ইত্যাদি। ধর্মের বাইরে খুব সামান্য পরিসরে আরও কিছু মিরাকল প্রচলিত আছে, যেমন ভিনগ্রহের প্রাণী, ইউএফও, টেলিপ্যাথি, রেইকি, অতিন্দ্রীয় দৃষ্টি ইত্যাদি। তবে এ ধরনের মিরাকল পশ্চিমা বিশ্বে যে মাত্রায় প্রচলিত আছে আমাদের দেশে এখনো সেই রেশ পৌঁছায়নি। এর কারণ হতে পারে পশ্চিমা দেশগুলোর মতো আমাদের এখানে প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেনি। ভিনগ্রহের প্রাণী বা ইউএফও সম্পর্কে তথ্য প্রচারের সাথে জ্যোতিবি©জ্ঞান ও উন্নত প্রযুক্তির সম্পর্কে আছে।
প্রতিটি ধর্মই মিরাকলে ভর্তি। কোনো ধর্মই তাদের নিজেদের লৌকিক দাবি করে না। আজকের এই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু মুসলমানদের মধ্যে বহুল প্রচারিত একটি মিরাকলের ওপর আলোকপাত করা। তবে আলোচনাটিকে সহজবোধ্য ও ব্যাখ্যাসদৃশ করার জন্য আমরা কোরান এবং ইসলাম ধর্মের বাইরের আরো কিছু বিষয়কে ছুঁয়ে যাব।
বাংলাদেশ একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র এবং শিক্ষার মান যথেষ্ট নিম্নমুখী হওয়ায় এ দেশ মিরাকল বিকাশের একটি উবর ভূমি। এ দেশে ধর্ম এক শ্রেণীর মানুষের কাছে এতো বেশি অন্ধ-আনুগত্য-বিশ্বাসের বিষয় যে, ধর্ম ছাড়া তাদের পক্ষে এক মুহূর্ত নিঃশ্বাস নেওয়া সম্ভব নয়। ধর্মের সাথে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন অথচ ধর্মের নাম ভাঙিয়ে বা জড়িয়ে কোনো কিছু শোনানো হলে, সেটা তারা বিনা প্রশ্নে বিশ্বাস করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেন না। জ্যোতিষী, পীরবাবার ব্যবসা এ কারণেই টিকে আছে। শহরাঞ্চলে কম থাকলেও গ্রামে-গঞ্জে ভূত-পেত্নী-পরী-বাণ মারা-জাদু করা-মারণ-উচাটন-পানি পড়া ইত্যাদিতে বিশ্বাস করার লোকের অভাব নেই। নব্বইয়ের দশকে ইরাকের কুয়েত দখলের পর যখন আমেরিকার সাথে ইরাকের যুদ্ধ চলছিল, ঐ সময় একদিন খবর ছড়ালো আকাশে সাদ্দামকে দেখা যাচ্ছে! কিছুক্ষণের মধ্যেই মানুষ একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ল আকাশে সাদ্দামকে দেখার জন্য; রাস্তাঘাটে জ্যাম লেগে গেল, বাড়ির ছাদে লোকেলোকারণ্য। ইরাক-আমেরিকার ঐ যুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান যাই হোক, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ প্রায় সবাই ইরাকের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। সাদ্দাম হোসেনের জনপ্রিয়তা তখন বাংলাদেশীদের কাছে তুঙ্গে। মানুষের ঐ দুব©ল অনুভূতিকে পুঁজি করে যে বা যারাই এই গুজব ছড়িয়ে দিয়েছিল সাথে সাথেই এই খবর গণহিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত করে। মানুষের প্রতিদিনকার সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান এক নিমিষেই রহিত হয়ে যায়। শুরু হয় উন্মাদনা। পরবর্তীতে (ইরাকের পরাজয় যখন আসন্ন) এমন গুজবও ছড়িয়েছিল ফেরেশতারা সাদ্দাম বাহিনীকে সহায়তা করা জন্য দলে দলে আকাশ থেকে ইরাকের দিকে ছুটে যাচ্ছেন!
প্রতিটি মিরাকলই গুজবের সমষ্টি। কাল্পনিক। রহস্যমণ্ডিত অজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল। মূল তথ্য বা ঘটনার বিকৃতি হয়ে থাকে নানা ভাবে। মিরাকলের প্রতি সাধারণ মানুষের পপাত থাকলেও বাস্তবতার কোনো ভিত্তি নেই। যুগে যুগে কিছু মিরাকলের পরিবর্তন হয়েছে। যেমন একটা সময় ছিল সূর্য ও চন্দ্রকে ‘জীবন্ত অলৌকিক সত্ত্বা’ ভেবে পূজা করা হতো। কিন্তু চাঁদের মাটিতে মানুষের পদার্পণের পর অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী কতিপয় মানুষের এই ‘অলৌকিক চন্দ্র-সূর্য’ বিশ্বাসে হোঁচট লেগেছে; বাধ্য হয়েছেন গ্রহ-নত্র সম্পর্কিত পূর্বের বিশ্বাসে পরিবর্তন আনতে। মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের উrসই হচ্ছে মিরাকল মেনে নেওয়া। বাংলা ভাষার একটি সাধারণ বাগধারা হচ্ছে ‘তিলকে তাল করা’। কিন্তু মিরাকল বাস্তবতাকে শুধু ‘তাল’ করে না, কুমড়ো বানিয়ে ছাড়ে! বিখ্যাত স্কটিস দার্শনিক ডেভিড হিউম (১৭১১-১৭৭৬) তাঁর ‘An Inquiry Concerning Human Understanding’ গ্রন্থে মিরাকল বা অলৌকিকতা বলতে বুঝিয়েছেন[1] : “A miracle is a transgression of a law of nature by a particular volition of the Deity, or by the interposition of some invisible agent.” মানুষ কেন মিরাকল বিশ্বাস করে, তার কারণ বহুমাত্রিক। একটি কারণ হতে পারে, যতদিন মানুষ ঈশ্বরের অস্তিত্বে এবং ধর্মগ্রন্থের বাণীকে অপৌরষেয় বলে বিশ্বাস করবেন, ততদিন ‘মিরাকল’ ভাবনা মুলোর মত মানুষের মনে ঝুলে থাকবে।
বিজ্ঞান কি ‘মিরাকল’ বা অলৌকিক কোনো কিছুর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারে? কিংবা বিজ্ঞান কি কোনো কিছুকে ‘মিরাকল’ বলে ঘোষণা করতে পারে? মোটেই না। সহজ কথায় যা লৌকিক নয়, তাই অলৌকিক। ‘মিরাকল’ বলতে স্পষ্টই বোঝায় প্রাকৃতিক নিয়মের (Laws of Nature) পরিপন্থী কোনো কিছু। বিজ্ঞান সম্পূর্ণ লৌকিক, বস্তুবাদী। বিজ্ঞানের যে কোনও শাখায় গবেষণার প্রথম ধাপ হচ্ছে ঘটনা বা বিষয়গুলিকে সন্দেহাতীতভাবে বিশ্লেষণ করা। এখানে ‘লৌকিক’ বিষয়টি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বা মেথডের সাথে জড়িত। বিজ্ঞান মানে কেবল কিছু ঘটনা বা বিষয়কে (পৃথিবীর সাথে চন্দ্রের দূরত্ব, সূর্যের দূরত্ব, পৃথিবীর বয়স, মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী প্রাণীর পার্থক্য, ইত্যাদি) জানা বা চিহ্নিত করা বোঝায় না; বিজ্ঞান স্পষ্টই বৈজ্ঞানিক প্রকৃতির (Nature of Science) সাথে সম্পর্কিত; যথা বৈধ প্রমাণের বৈশিষ্ট্য (the criteria of valid evidence), অর্থবোধক গবেষণার নক্সা (the design of meaningful experiments), সম্ভাবনার সুনির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ণয় (the weighing of possibilities), গবেষণার জন্য গৃহীত অনুকল্পগুলোর পরীক্ষণ (the testing of hypothesis), উপযোগী তত্ত্ব গঠন (the establishment of useful theories) ইত্যাদি যা এই পার্থিব জগতের কোনো নির্দিষ্ট ফেনোমেনা সম্পর্কে যথার্থ, নির্ভরযোগ্য এবং অর্থবোধক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সহায়তা করে। বিজ্ঞানই আমাদের সামনে উন্মোচন করেছে প্রাকৃতিক আইন বা নিয়মের রাশি। বিজ্ঞান ছাড়া এই প্রাকৃতিক আইন বোঝার চেষ্টা অবান্তর এবং ভ্রান্তও বটে। বৈজ্ঞানিকদের গবেষণা করার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি (Method) রয়েছে, যেমন : অবরোহ (Deductive) পদ্ধতি, আরোহ (Inductive) পদ্ধতি, গবেষণার ফলাফলে অভিন্নতা (Replicability), মিথ্যা প্রতিপন্নকরণ (Falsifiability) ইত্যাদি। বিজ্ঞানের এই প্রতিটি পদ্ধতিরই আবার কিছু মৌলিক নীতি (Principle) রয়েছে, যেমন : সংজ্ঞা নির্ধারণ, কার্য-কারণ সম্পর্ক (Cause and Effect relationship), গবেষণার জন্য সংগৃহীত ডেটা (Data) বা উপাত্তের মধ্যে স্ববিরোধিতা-আত্মবিরোধিতা না থাকা (Law of non self-contradiction), একই কারণ সব সময় একই ফল দেবে (Law of uniformity of nature), কারণগুলো অবশ্যই বোঝা যাবে ইত্যাদি। উল্লেখ্য, ধর্মগ্রন্থের বাণীর ক্ষেত্রে দেখা যায় একটি মাত্র আয়াত বা শব্দগুচ্ছকে নিয়ে ডজন-ডজন ব্যাখ্যাকার ডজন-ডজন ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকেন, নিজস্ব ভিন্নমত ব্যক্ত করেন, ফলে একই আয়াতে বা শব্দগুচ্ছকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের পরস্পর-বিরোধী ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এই পরস্পর-বিরোধী ব্যাখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ‘গড ইন দ্যা গ্যাপ্স’ পূরণ করে কেউ কেউ উত্তর দেন, ‘এর আসল অর্থ একমাত্র স্রষ্টাই জানেন, স্রষ্টাই সর্বজ্ঞ।’
কোনো একটি গবেষণার জন্য সংগৃহীত হাজার হাজার উপাত্তের মধ্যে যদি একটি উপাত্তের সাথে অন্যগুলোর আত্মবিরোধিতা থাকে, কোন একটি উপাত্ত যদি বিশ্লেষণের সময় ভুল প্রমাণিত হয়, কিংবা উপাত্তগুলো এমন যে ‘মিথ্যাপ্রতিপন্নকরণ’ করার সুযোগ নেই তখন গোটা গবেষণাটাই খারিজ হয়ে যায়। ‘রিসার্চ প্রবলেম’ পরিবর্তন করতে হয়। আবার গবেষণার জন্য যে প্রবলেম (গবেষণার বিষয়) বেছে নেওয়া হল, সেই প্রবলেমের টার্মগুলো যদি এমন হয় ‘কার্যকরী সংজ্ঞা’ (Operational definition) নির্ধারণ-ই করা যাচ্ছে না বা ভাসাভাসা-অস্পষ্ট থাকে তবে ‘গবেষণা’ প্রথম ধাপেই বাতিল হয়ে যায়।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ‘লৌকিক’ বলতে বুঝায় যে বিষয় বা ঘটনা বৈজ্ঞানিক প্রকৃতি বা পদ্ধতির মৌলিক নীতিমালাকে অতিক্রম করে না এবং বিজ্ঞান তার পদ্ধতির মাধ্যমেই ঐ বিষয় বা ঘটনাকে বিশ্লেষণ-ব্যাখ্যা-উদ্ঘাটন করে থাকে। কিন্তু সাধারণ মানুষ যেহেতু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্পর্কে খুব বেশি ওয়াকিবহাল নন, তাই তাদের কাছে যে বিষয় বা ঘটনা সাধারণের অসাধ্য, (কাল্পনিক বক্তব্য) পূর্বের চেনা জগতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় তাই ‘অলৌকিক’ বলে বিশ্বাস করেন। যেমন নবী মুহাম্মদের মিরাজে গমন।
ইদানীং কিছু কৌশলী ধর্মবাদী তাঁদের ধর্মগ্রন্থকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের জন্য বিজ্ঞানের আশ্রয় নিচ্ছেন। বিজ্ঞানের সাথে ধর্মগ্রন্থের বাণী মেলানোর জন্য যত চালাকির দরকার হয়, সেগুলোর কোনোটাই বাদ রাখছেন না। কারণ বিজ্ঞান ইতিমধ্যে সাধারণ শিক্ষিত লোকের মনে এই আস্থা স্থাপন করতে পেরেছে যে, ‘মানুষের কল্যাণেই বিজ্ঞান, অজানাকে জানার জন্য বিজ্ঞান ছাড়া কোনো উপায় নেই, বিজ্ঞান মানবীয় আবেগ নিরপেক্ষ, বিজ্ঞান গবেষণার মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, যা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।’ তাই ধর্মকে ভবিষ্যতের বাজারে টিকে থাকার জন্য বিজ্ঞানের কোলে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু ধর্মগ্রন্থের বাণী বা অলৌকিকতা আর বিজ্ঞানের কর্মপ্রক্রিয়া পরস্পর বিপরীতমুখী। একটার সাথে আরেকটার সমন্বয়ের কোনো সুযোগই নেই; সংঘাতের ইতিহাস তো খুবই পুরানো। তারপরও শেষ চেষ্টা হিসেবে অন্তহীন জাড়িজুড়ি করে যাচ্ছেন কতিপয় অসাধু ধর্মবাদী। উদাহরণ, রাশেদ খলিফার আবিষ্কৃত কোরানের মিরাকল উনিশ।
আমাদের এই প্রবন্ধে আল-কোরানের কথিত ‘উনিশ’ মিরাকল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে, যথাস্থানে তথ্যসূত্র উল্লেখ করা আছে। পাঠকের কাছে বিনীত অনুরোধ, প্রবন্ধটির বক্তব্য, তথ্য, যুক্তি গ্রহণ বা বর্জনের আগে অবশ্যই নিজে যথাসম্ভব যাচাই করে নিবেন। খোলা মনে বিচার করবেন। শুধুমাত্র ‘পূর্ববিশ্বাস বা আবেগের বশবর্তী হয়ে’ বর্জন করা কিংবা ‘বিরুদ্ধ মত’ হিসেবে আমাদের বক্তব্যে আস্থা স্থাপন করা এই প্রবন্ধের কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য নয়। জনমানসে যৌক্তিক চেতনা-বিজ্ঞানমনস্কতা বিকাশই উদ্দেশ্য।
(১) ইংরেজিতে ‘Pareidolia’ বলে একটি শব্দ প্রচলিত আছে, অর্থ হল : এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক বিষয় যা অস্পষ্ট (vague) ও এলোমেলো উদ্দীপনার (random stimulus) কারণে ভ্রান্ত অনুভূতি বা Illusion-এর সৃষ্টি করে। ইন্দ্রিয়গ্রাহী উদ্দীপকের প্রভাবে প্রত্যক্ষণ বা উপলব্ধি হয় বলে আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের যে কোনো একটির জন্য ইলিউশন হতে পারে। তবে এই ইলিউশনের জন্য আমাদের ইন্দ্রিয় দায়ী নয়, স্নায়ুসংকেত বিশ্লেষণে মস্তিষ্কের অক্ষমতাই এই ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। মানব মনের একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আমরা যা দেখি বা উপলব্ধি করি, তা (অনেক সময় অজান্তেই) আমাদের চেনা জগতের সাথে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করি-তুলনা করি। হঠাৎ করে নতুন কিছু দেখলে পূর্বের দেখা কোনো বিষয়ের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য খোঁজার চেষ্টা করি; যেমন দুটি বিন্দু পাশাপাশি বসিয়ে যদি এর নীচে অর্ধ-চন্দ্রাকৃতি একটি ছোট রেখা টানা হয়, অনেকের কাছেই একে ‘মানুষের মুখমণ্ডলের অবয়ব’ বলে মনে হবে। অথচ এই চিত্রে মানুষের মুখমণ্ডলের সাথে সাদৃশ্যের চেয়ে বৈসাদৃশ্যের পরিমাণ অনেক বেশি। প্রায়শই মানুষ চিন্তায় বৈসাদৃশ্যের থেকে সাদৃশ্যের ওপর গুরুত্ব দেয়। তাই অস্পষ্ট এবং ভাসাভাসা কোনো কিছু দেখলে অনেক সময় পরিচিত কোন জিনিস বা বিষয়ের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়; যেমন মেঘমুক্ত আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় তুলোর মত টুকরো টুকরো ভেসে বেড়ানো মেঘমালায় বুঝি কারো মুখের প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে। কখনোবা চাঁদের গায়ে দেখা যায় কারও ছবি। আকাশে ইউএফও কিংবা মঙ্গল গ্রহে মানুষের মুখমণ্ডলের প্রতিকৃতি দেখা যাচ্ছে, এরকম প্রচুর বানোয়াট ছবি বাজারে রয়েছে। ২০০২ সালের ১৮ জুলাই ব্রাজিলের এক নাগরিক দাবি করলেন তার বাড়ির জানালার কাঁচে ‘কুমারী মাতা’ মেরির ছবি ফুটে ওঠেছে। বছর খানেক আগে কোন এক রাত্রিবেলা শুনা গেল হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা দাবি করছেন চাঁদের গায়ে ‘শিবের অবতার’ লোকনাথের ছবি দেখা যাচ্ছে। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে কী হৈচৈ! ২০০৬ সালের পহেলা জুন রব নাভাস নামের এক পাকিস্তানি মৎসজীবী এক ধরনের সামুদ্রিক মাছের (rabbit fish) পেটের মধ্যে আরবি অক্ষরে ‘আল্লাহ’ লেখা খুঁজে পেলেন।[2] দুবাইয়ের বিখ্যাত মাছের বাজার Shindagha-এ পরবর্তীতে ঐ মাছটি প্রদর্শনীর জন্য নিয়ে আসা হয়। এর আগে ২০০৪ সালের ২৪ মার্চ ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের হেবরন শহরে সহস্রাধিক মানুষ জটলা পাকিয়েছেন একটি সদ্য-ভূমিষ্ট মেষ শাবক দেখার জন্য। শাবকটির মালিক ইয়াহিয়া আতরাস দাবি করছেন, ‘সদ্য ভূমিষ্ট মেষ শাবকটির গায়ের একদিকে আরবি হরফে ‘আল্লাহ’ লেখা এবং অন্যপাশে ‘মুহাম্মদ’ লেখা।’[3] ২০০৭ সালের ১৩ অক্টোবর এ্যালেন স্টোন নামের এক ব্যক্তি তার বাড়ির পিছনের আঙিনাতে একটি পাথর কুড়িয়ে পেলেন, পাথরের অস্পষ্ট খাজের মধ্যে আঁকাবাঁকা রেখা রয়েছে।[4] ভদ্রলোক দাবি করতে লাগলেন, এটা যীশুর প্রতিকৃতি! একই বছরের ১৫ অক্টোবর তারিখে ভ্যাটিকেন টিভি চ্যানেল দুটি ছবি পাশপাশি দেখিয়ে গুজব ছড়ালো : ‘কবরের পাশে আগুন জ্বলছে; সেই আগুনের লেলিহান শিখা বাতাসের কারণে এঁকেবেঁকে গেছে। আগুনের শিখাটি পোপ দ্বিতীয় জন পলের আবছায়া প্রতিকৃতি বলে মনে হচ্ছে।’[5] উপরের এই সবগুলো ঘটনাই Pareidolia উদাহরণ। মানুষের দুর্বল অনুভূতির স্থান বলে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে গুজব ছড়ায় বেশি, আর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার অজুহাতে বেশিরভাগ সময় এই সব গুজবের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান করতে দেওয়া হয় না। জন্মের পর থেকে শৈশব, শৈশব পেরিয়ে কৈশোর পর্যন্ত তথাকথিত অতিপ্রাকৃত শক্তি বা আল্লাহ-ভগবান-ঈশ্বরের কথা শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই এদের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিশ্বাস জন্মে যায়, চিন্তার কুঠরিতে ভক্তি-ভয়ের সৃষ্টি হয়। তার ওপর রয়েছে ধর্মীয় উপাসনার রীতিকে অবুঝ মনের ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। ফলে শৈশবেই মানুষের মনে বা চিন্তায় ঈশ্বর-ভগবান-আল্লাহ সম্পর্কে এক ধরনের ‘প্যারাডাইম’ গড়ে ওঠে। অলৌকিক কোনো কিছুর অস্তিত্ব কম্মিনকালে না থাকলেও ‘পরিস্থিতির শিকার’ মানুষ বাধ্য হয় অলৌকিকতা দেখতে!
(২) Ernest Vincent Wright (১৮৭৩?-১৯৩৯) নামের একজন মার্কিন লেখক ‘Gadsby: Champion of Youth’ (Wetzel Publishing Co., ১৯৩৯) নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন। উপন্যাসটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পঞ্চাশ হাজার একশত দশটি শব্দ দিয়ে গোটা উপন্যাস লেখা হলেও লেখক কোথাও একটি বারের জন্য ইংরেজি ‘E’ স্বরবর্ণটি ব্যবহার করেননি। অর্থাৎ ইংরেজিতে ‘E’ অর ব্যবহার করে যত শব্দ (he, she, they, them, theirs, her, herself, myself, himself, yourself, love, hate, etc.) আছে সেগুলো বাদ দিয়ে বাকি ২৫টি অর দিয়ে তৈরি শব্দ ব্যবহার করেছেন, বাক্য তৈরি করেছেন; অথচ এর ফলে ব্যাকরণগত ভুল, বাক্যের অসামঞ্জস্যতা, ভাব প্রকাশের দুর্বলতা বা ঘাটতি কোথাও পরিলক্ষিত হয়নি। নীচে ‘Gadsby’ উপন্যাসটির প্রথম প্যারাগ্রাফ তুলে দেওয়া হল[6] :
“If youth, throughout all history, had a champion to stand up for it; to show a doubting world that a child can think; and, possibly, do it practically; you wouldn't constantly run across folks today who claim that "a child don't know anything." A child's brain starts functioning at birth; and has, amongst its many infant convolutions, thousands of dormant atoms, into which God has put a mystic possibility for noticing an adult's act, and figuring out its purport.”
লেখকের এই কৃতিত্ব আর দতার জন্য তিনি কিন্তু এর জন্য কোনো ‘মিরাকল পাওয়ার’-এর বহিঃপ্রকাশ বলে দাবি করেননি। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, পরিশ্রম, সৃষ্টিশীলতার দ্বারা আপাতদৃষ্টিতে অনেক ‘অসম্ভবকে’ই ‘সম্ভবের গণ্ডি’তে আবদ্ধ করা সম্ভব।
(৩) গণিত নিয়ে যাদের অল্প-বিস্তর লেখাপড়া আছে তারা অবশ্যই ‘ফিবোনাক্কি রাশিমালা’ সম্পর্কে অবগত আছেন। এই রাশিমালা আমাদের সামনে প্রকৃতি মাতার অপার রহস্যের অবগুণ্ঠন উন্মোচন করে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। ‘ফিবোনাক্কি রাশিমালা’র জন্মদাতা ইতালির নাগরিক Leonardo Pisano (১১৭৫-১২৫০) মৃত্যুর আগে একদা তাঁর তৈরি রাশিমালা নিয়ে জিজ্ঞাস্য হলে রহস্য করে বলেছিলেন, ‘প্রকৃতির মূল রহস্য এই রাশিমালাতে আছে।’[7] কি সেই রহস্য? সেটা জানার আগে এক ঝলক রাশিমালাটা দেখে নিই : আমাদের প্রচলিত ডেসিমেল পদ্ধতির রাশিমালা হচ্ছে ০, ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯। এভাবে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। মৌলিক রাশিমালা হচ্ছে ১, ৩, ৫, ৭, ১১, ১৩, ১৭, ১৯ ইত্যাদি। আর ফিবোনাক্কি রাশিমালা হচ্ছে ০, ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫, ৮৯, ১৪৪, ২৩৩, ৩৭৭, ৬১০, ৯৮৭ ... ইত্যাদি। অর্থাৎ ফিবোনাক্কির রাশিমালাটা তৈরি হয়েছে প্রথম দুইটি রাশির যোগফল সমান পরবর্তী রাশি; ০ + ১ = ১, ১ + ১ = ২, ২ + ১ = ৩, ৩ + ২ = ৫, ৫ + ৩ = ৮, ৮ + ৫ = ১৩, ৮ + ১৩ = ২১ ইত্যাদি। এভাবে অদ্ভূত নিয়মে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে এই রাশিমালার মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষ করা যায়, যথা : এ রাশিমালার যে কোন চারটি সংখ্যা নেওয়া হলে প্রথম ও চতুর্থ সংখ্যার যোগফলের সাথে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যার যোগফল বিয়োগ করা হলে ফলাফল অবশ্যই সবসময় ঐ চারটি সংখ্যার প্রথমটি হবে। ধরা যাক চারটি ফিবোনাক্কি রাশি ২, ৩ , ৫, ৮। প্রথম ও চতুর্থ সংখ্যার যোগফল (২ + ৮) ১০, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যার যোগফল (৩ + ৫) ৮ বিয়োগ করলে বিয়োগফল হচ্ছে ২, যা কিনা আমাদের ধরে নেওয়া চারটি সংখ্যার প্রথম সংখ্যা। আমরা সাধারণত ডেসিমেল পদ্ধতিতে হিসেব করে এতো অভ্যস্ত যে, কোন কিছুর গণনায় ডেসিমেল সংখ্যা (০, ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯) দ্বারাই কোন কিছুর হিসেব করে থাকি; যেমন ঘড়ি দ্বারা সময় নির্ণয়, টাকা-পয়সার লেনদেন, বাজার-সদাই ইত্যাদি। কিন্তু বিস্ময়করভাবে প্রকৃতির নানা স্তরে ফিবোনাক্কি রাশিমালার ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে, যেমন : সূর্যমুখী ফুলের পাপড়ি বিন্যাসে, ক্যকটাস গাছের পুরুত্বে, পাইন গাছের মোচায় ফিবোনাক্কি রাশিমালার সংখ্যা পাওয়া যায়। শামুকের যে স্পাইরাল দেখা যায় সেখানেও ফিবোনাক্কির রাশিমালার উপস্থিতি রয়েছে। শীতের সময় আমাদের দেশে সুদূর সাইবেরিয়া হতে ‘অতিথি পাখি’ ঝাকে ঝাকে আসে। পাখিদের নিজেদের অঞ্চলে উষ্ণ আবহাওয়া দেখা দিলে স্থান পরিবর্তন করে তারা অন্য শৈত্য এলাকায় গমন করে। এই অতিথি পাখির ঝাক গণনা করে দেখা গেছে তাদের একেকটি ঝাকে ২১টি পাখি থাকে, ২২ বা ২৩টি পাখি থাকে না। মজার ব্যাপার ফিবোনাক্কি সিরিজে ২১ সংখ্যাটি রয়েছে, ২২ বা ২৩ সংখ্যা নেই। মৌমাছিদের জীবনযাত্রায়ও রয়েছে ফিবোনাক্কি রাশিমালার উপস্থিতি। মৌমাছিরা সাধারণত কলোনি করে থাকে। প্রতিটি কলোনিতে একটি পুরুষ মৌমাছির পিতা-মাতা ১ জন, দাদা-দাদী ২ জন, প্রপিতা-মাতা ৩ জন, প্রপিতা-মাতার পিতা-মাতা ৫ জন এবং এদের পিতা-মাতা ৮ জন। এভাবে ক্রমেই মৌমাছির বংশতালিকায় ফিবোনাক্কি রাশিমালার সংখ্যার খোঁজ পাওয়া যায়।
সুখের সংবাদ প্রকৃতির এতো বৈচিত্রময় স্থানে ফিবোনাক্কি রাশিমালার উপস্থিতি দেখা গেলেও এখন পর্যন্ত এই রাশিমালাকে এর জন্মদাতা ফিবোনাক্কি বা অন্য কেউ ‘অলৌকিক রাশিমালা’ বলে দাবি করেননি।
(৪) ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর আমেরিকায় ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হামলার পর সেখানকার জনসাধারণের মধ্যে ‘১১’ সংখ্যাটি নিয়ে একটি অতিলৌকিক-আধোভৌতিক পটভূমি তৈরির চেষ্টা হয়েছিল। এ পটভূমির উদ্যোক্তা হিসেবে আছেন ইজরাইলের সাবেক গুপ্তচর, সাবেক জাদুকর এবং বর্তমানে অতীন্দ্রিয় মতার সম্রাট হিসেবে (কু)খ্যাত ইউরি গ্যালার[8] ; তিনি ১১ই সেপ্টেম্বরের পরপরই সবাইকে (বিশেষ করে আমেরিকানদের) উপদেশ দান করেন প্রত্যেকেই যেন প্রতিদিন ১১ সেকেন্ড করে প্রয়োজন মত প্রার্থনা করেন।[9] কারণ তাঁর মতে : ‘১১ হচ্ছে একটি রহস্যময় সংখ্যা, এর মধ্যে অপ্রাকৃত গোপন নানা তথ্য লুকানো রয়েছে এবং এ সংখ্যা দুনিয়ার পার্থিবতা এবং অপার্থিবতার সংযোগ সেতু।’ ইউরি গ্যালার শুধু বক্তব্য দান করেই ক্ষান্ত হননি, ৯/১১-এ ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলার সাথে ‘১১’ সংখ্যাটির একটি সম্পর্ক আবিষ্কার করেন। নীচে তাঁর আবিষ্কৃত সম্পর্কটির উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরা হল[10] :
v সন্ত্রাসী হামলার তারিখ ৯/১১ : ৯+১+১=১১।
v ১১ই সেপ্টেম্বর বছরের ২৫৪তম দিন : ২+৫+৪=১১।
v ১১ই সেপ্টেম্বর পর বছর শেষ হতে ১১১ দিন বাকি থাকে।
v ১১৯ হচ্ছে ইরাক/ইরানের রাষ্ট্রীয় কোড ১+১+৯=১১। রাষ্ট্রীয় কোডটি উল্টো করে গণনা করলে হামলার তারিখটি আবার সামনে চলে আসে। [উপরোক্ত তথ্য মিথ্যা। ইরানের রাষ্ট্রীয় কোড ৯৮ অর্থাৎ ৯+৮=১৭ এবং ইরাকের রাষ্ট্রীয় কোড ৯৬৪ অর্থাৎ ৯+৬+৪=১৯, সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় কোড ৯৬৬ অর্থাৎ ৯+৬+৬=২১]
v আক্রমণস্থল টুইন টাওয়ার দেখতে ইংরেজি ১১-এর মত।
v প্রথম আক্রমণকারী বিমান : ‘ফাইট-১১।’ আমেরিকার এয়ারলাইন্সকে ইংরেজিতে সংক্ষেপে ‘AA’ বলা হয়। এই ‘AA’ ইংরেজি বর্ণমালার প্রথম বর্ণ, পাশাপাশি সাজালে ১১।
v ইংরেজি ‘Afghanistan’ শব্দটিতে ১১ অর রয়েছে।
v ইংরেজি ‘New York City’ শব্দটিতে ১১ অর রয়েছে। আমেরিকাতে ‘New York’ ১১তম রাজ্য। [নিউইয়র্কের সাথে ‘City’ শব্দ জুড়ে দিয়ে ১১টি অর গণনা করা হয়েছে, কিন্তু আফগানিস্তানের সাথে ‘Country’ শব্দ ধরা হয়নি।]
v ইংরেজি ‘The Pentagon’ শব্দটিতে ১১ অর রয়েছে।
v এছাড়া ইংরেজি ‘George W. Bush’, ‘Bill Clinton’, ‘Saudi Arabia’, ‘Colin Powell’ শব্দগুলিতে ১১ অক্ষর রয়েছে।
(৫) সংখ্যা দিয়ে বিন্যাস-সমাবেশ করে ধর্মগ্রন্থকে অলৌকিক দাবি করার অভ্যাস বেশ পুরানো। রুশ বংেশ্দ্ভূাত গণিতবিদ এবং খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিক ড. ইভান পেনিন (১৮৫৫-১৯৪২) একদা দাবি তুলেছিলেন বাইবেল ‘ধর্মগ্রন্থটি ৭ সংখ্যা দ্বারা চমৎকারভাবে আবদ্ধ।’[11] বাইবেলের (ওল্ড টেস্টামেন্ট) প্রথম আয়াত : ‘In the beginning God created the heavens and the earth.’ (সৃষ্টির শুরুতেই ঈশ্বর আসমান এবং জমিন সৃষ্টি করলেন)। (জেনেসিস, ১:১)। উক্ত আয়াতে হিব্রু ভাষায় ৭টি শব্দ আছে এবং ২৮টি অর আছে (৭×৪)। তিনটি বিশেষ্য (noun) রয়েছে যথা ঈশ্বর (God), আসমান (heavens), জমিন (earth)। হিব্রু ভাষায় যেহেতু কোনো সংখ্যা নেই, বর্ণগুলোর যোগফলই হচ্ছে সংখ্যা মান (numeric value)। তাই এই আয়াতের তিনটি বিশেষ্যের সংখ্যামান হচ্ছে ৭৭৭ (৭×১১১)। আয়াতটির ক্রিয়াপদ ‘created’-এর সংখ্যা মান হচ্ছে ২০৩ (৭×২৯)। আয়াতটির Object হচ্ছে প্রথম তিনটি শব্দ ‘In the beginning’; ১৪টি বর্ণ দিয়ে গঠিত (৭×২) এবং বাকি চারটি শব্দও (Subject) ১৪টি বর্ণে গঠিত। হিব্রু ভাষায় আয়াতটির চতুর্থ ও পঞ্চম শব্দদুটিও ৭টি বর্ণে গঠিত। ক্রিয়াপদ ‘created’-এর প্রথম, মধ্যম এবং শেষ বর্ণের সংখ্যা মান ১৩৩ (৭×১৯)। আয়াতের সব কটি শব্দের প্রথম এবং শেষ বর্ণের সংখ্যা মান ১৩৯৩ (৭×১৯৯)। বাইবেলের মধ্যে লেখক হিসেবে ২১ জন ব্যক্তির নাম রয়েছে (৭×৩)। হিব্রু ভাষায় তাঁদের নামের সংখ্যা মান ৭ দ্বারা বিভাজ্য। এই ২১ জনের মধ্যে ৭ জনের নাম রয়েছে নিউ টেস্টামেন্টে, যথা : Moses, David, Isaiah, Jeremiah, Daniel, Hosea and Joel। এই ৭টি নামের সংখ্যা মান হল ১৫৫৪ (২২২×৭)। ডেভিড নামটি পাওয়া যায় ১১৩৪ বার (১৬২×৭)। বাইবেলে ‘seven-fold’ শব্দগুচ্ছটি (phrase) ৭ বার রয়েছে, ‘৭০’ এসেছে ৫৬ বার (৭×৮), ঈশ্বর সৃষ্টির জন্য ৭ দিন সময় নিয়েছেন, ইজরায়েলিরা ৭ দিনে ৭ বার মার্চ করেছে জেরিকোর দিকে। শেষ গ্রন্থ ‘প্রকাশিত কালাম’ (Revelation)-এ রয়েছে ৭ জন পবিত্র আত্মা ৭টি তূর্য (trumpet) নিয়ে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, তাছাড়া রয়েছে ৭টি স্বর্ণের বাতির স্ট্যান্ড, ৭টি চার্চ, ৭টি তারা, ৭জন রাজা, ৭টি পাহাড়।[12] আবার Psalm 118 অধ্যায় সম্পর্কে দাবি করা হয়েছে, এটি বাইবেলের মাঝের অধ্যায়। Psalm 117 অধ্যায়টি সর্বকণিষ্ট এবং Psalm 119 অধ্যায়টি সবচেয়ে দীর্ঘ অধ্যায়। Psalm 118 অধ্যায়ের আগে ৫৯৪টি অধ্যায় রয়েছে এবং Psalm 118 অধ্যায় পরে আরো ৫৯৪টি অধ্যায় রয়েছে।[13]
স্বীকার করছি, আমরা এই প্রবন্ধের লেখক দুজনের কেউই হিব্রু ভাষা জানি না। তাই উপরোক্ত হিব্রু ভাষার দাবিগুলো যথার্থভাবে অনুসন্ধান করা আমাদের পে সম্ভব নয়। খ্রিস্টানদের দাবিকৃত ‘মিরাকল ৭’ ভাষ্য তুলে দেওয়ার কারণ হল পাঠকের মনে কিছু প্রশ্নের সূত্রপাত ঘটানো, তাদের চিন্তার খোরাক যোগানো।
জন্ম : নভেম্বর ১৯, ১৯৩৫ (মিশর)
মৃত্যু : জানুয়ারি ৩১, ১৯৯০ (বয়স ৫৪)
জাতীয়তা : মিশরীয়-আমেরিকান
পেশা : জৈব-রসায়নবিদ
ধর্মীয় বিশ্বাস : ইসলাম, United Submitters International (USI)
জীবন-বৃত্তান্ত : রাশেদ খলিফা (Rashad Khalifa) কায়রোর এইন শামস্ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে উচ্চশিা লাভের জন্য ১৯৫৯ সালে আমেরিকাতে আসেন এবং ১৯৬৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ. ডি ডিগ্রি অর্জন করেন জৈব-রসায়নবিদ্যায়। ১৯৭৫-৭৬ সালে তিনি প্রায় বছর খানেক লিবিয়া সরকারের বিজ্ঞান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে রসায়নবিদ হিসেবে জাতিসংঘের অধীনে ভিয়েনাতে শিল্প উন্নয়ন সংস্থায় যোগ দেন এবং সেখান থেকে ১৯৮০ সালের দিকে সিনিয়র রসায়নবিদ হিসেবে আমেরিকার এরিজোনা রাজ্যের সরকারি রসায়ন বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি প্রায় বিশটির মত বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেছেন, নিজে কোরান অনুবাদ করেছেন ইংরেজিতে এবং ধর্মবিষয়ক বিভিন্ন প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থের নাম : ‘The Computer Speaks: God’s Message to the World’ রাশেদ খলিফার লেখা গ্রন্থ, আর্টিকেল বা গবেষণা সম্পর্কিত আলোচনা পাওয়া যায় এই ঠিকানায় : International Community of Submitters (ICS), P.O. Box 43476, Tucson, AZ 85733 এবং ওয়েব সাইট http://www.submission.org।
রাশেদ খলিফা ইসলাম ধর্মে ‘United Submitters International’ নামে নতুন একটি ধর্মীয় গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন; তাঁর অনুসারীরা নিজেদের ‘মুসলমান’ হিসেবে পরিচয় দেবার পরিবর্তে ‘Submitter’ এবং ইসলাম শব্দের পরিবর্তে ‘Submission’ শব্দ ব্যবহার করেন। রাশেদ খলিফা ও তাঁর অনুসারীদের ধর্মীয় বিশ্বাস : (১) আল-কোরান’ই একমাত্র গ্রহণীয় ধর্মগ্রন্থ। তবে এটিও বিকৃতির হাত থেকে রা পায়নি। (২) নবী মুহাম্মদের সুন্নাহ পুরোপুরি বাতিল; ধর্মীয় বিশ্বাস বা প্রথা হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। (৩) যে হাদিসগুলো সুন্নাহর সাথে বিরোধপূর্ণ সেগুলোও বাতিল। (৪) রাশেদ খলিফা নবী মুহাম্মদের পরে ইসলাম ধর্মের একজন রসুল। (৫) তাঁরা নবী ইব্রাহিমের রীতি অনুসরণ করে প্রার্থনা করে থাকেন (দ্রষ্টব্য : http://www.submission.org/salat-how.html); যদিও তেমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য উৎস নেই যে নবী ইব্রাহিম কিভাবে প্রার্থনা করতেন।
রাশেদ নিজের ইংরেজি অনুবাদকৃত কোরানের ‘সুরা ফুরকান’, ‘সুরা ইয়াসিন’, ‘সুরা শুরা’ এবং ‘সুরা তাক্ভির’-এর আয়াতে নিজের নাম ঢুকিয়ে তাঁর বক্তব্যের ‘ধর্মীয় গ্রহণযোগ্যতা’ আদায়ের চেষ্টা করেছেন। কোরানের আয়াতগুলি হচ্ছে: We have sent you (Rashad) as a deliverer of good news, as well as a warner. [25:56] (দ্রষ্টব্য: http://www.submission.org/suras/sura25.html); Most assuredly, you (Rashad) are one of the messengers. [36:3] (দ্রষ্টব্য: http://www.submission.org/suras/sura36.html); Are they saying, "He (Rashad) has fabricated lies about GOD!"? If GOD willed, He could have sealed your mind, but GOD erases the falsehood and affirms the truth with His words. He is fully aware of the innermost thoughts. [42:24] (দ্রষ্টব্য: http://www.submission.org/suras/sura42.html); Ges Your friend (Rashad) is not crazy. [81:22] (দ্রষ্টব্য: http://www.submission.org/suras/sura81.html)। অথচ ইউসুফ আলী, পিকথাল, শাকির-এর মত বিশ্বখ্যাত ইংরেজি অনুবাদক ও আমাদের দেশের বাংলা অনুবাদকের কেউই এই আয়াতগুলিতে ‘Rashad’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। (দ্রষ্টব্য: http://www.usc.edu/schools/college/crcc/engagement/resources/texts/muslim/quran/)। তিনি দাবি করেন : “ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মদ ‘শেষ নবী’ (last Prophet) হলেও শেষ রসুল (last messenger) ছিলেন না। কোরানের ৩৩ নং সুরা আহজাবের ৪০ নম্বর আয়াতে মুহাম্মদকে (সাঃ) শেষ নবী বলা হলেও শেষ রসুল বলা হয়নি। আল্লাহ ফেরেশতা এবং মানুষের মধ্যে থেকে রসুল মনোনীত করেন। (সুরা ২২, হজ, আয়াত ৭৫)।” এরপর নিজেকে ‘রসুল’ বলে দাবি করে কোরানের সুরা আল-ই-ইমরান-এর ৮১ নম্বর আয়াত উপস্থাপন করেন, যেখানে আল্লাহ ভবিষ্যতে একজন রসুল পাঠানোর ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। আর সুরা তওবার শেষের দুটি আয়াতকে (১২৮ ও ১২৯) ‘মিথ্যে দাবি’ করে তাঁর নিজের অনুবাদের কোরান থেকে বাদ দিয়ে দেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রাশেদ খলিফার এসব দাবি-বক্তব্য সাধারণ মুসলমান থেকে শুরু করে কট্টরপন্থীদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭৬ সালের প্রথম দিকে রাশেদ প্রথাগত মুসলমানদের সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছান।
১৯৬৯ সালের দিকে রাশেদ খলিফা কোরান শরিফের শব্দমালা, অক্ষর-বর্ণ ইত্যাদি বিশ্লেষণের জন্য একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরির প্রচেষ্টা শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে ঘোষণা করেন : তিনি কোরানের ৭৪ নং সুরা মুদ্দাচ্ছির-এর ৩০ নং আয়াতে উল্লেখিত ‘১৯’ থেকে এমন একটি গাণিতিক থিওরি আবিষ্কার করেছেন যা কোরানকে একদম ‘অলৌকিক’ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে; যেমন তাঁর দাবি হচ্ছে : ‘কোরানের সুরা সংখ্যা ১১৪, যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য, কোরানের আয়াত সংখ্যা ৬৩৪৬, যা ১৯ দিয়ে বিভাজ্য। কোরানে উল্লেখ করা ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ শব্দের মধ্যে ১৯টি অর রয়েছে। কোরানের প্রথম ওহি ৯৬ নং সুরা আলাক-এ ১৯টি শব্দ রয়েছে, ঐ সুরা আলাকটি শেষের দিক থেকে গণনা করলে ১৯তম অবস্থানে রয়েছে; এবং সর্বশেষ ওহি (১১০) সুরা নাসর-এর প্রথম আয়াতে ১৯টি বর্ণ রয়েছে।’ ইত্যাদি। (দ্রষ্টব্য: http://www.submission.org/quran/app1.html)।
রাশেদ খলিফার এই দাবি প্রথম দিকে পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী মহলে তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা ‘Scientific American’-তে ‘কোরানের কৌশলী পাঠ’ বলে প্রথম মন্তব্য প্রদান করেন আমেরিকার বিখ্যাত গণিতবিদ-বিজ্ঞানী মার্টিন গার্ডনার (Martin Gardner)। (দ্রষ্টব্য: Martin Gardner, The numerology of Dr. Rashad Khalifa-Scientist, Skeptical Inquirer, Sept-Oct, 1997)। মার্টিন গার্ডনার পরে আরও বিস্তারিতভাবে রাশেদ খলিফা এবং তাঁর কাজ সম্পর্কে মূল্যায়ণ করেন। তিন বছর পর ১৯৮৩ সালের এপ্রিল মাসে কানাডার ‘Council on the Study of Religion’ তাদের ‘Quarterly Review’ পত্রিকায় রাশেদ খলিফা আবিষ্কার সম্পর্কে মন্তব্য করে : “ an authenticating proof of the divine origin of the Quran.”
১৯৭৩ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম মিশরের ÔAkher Sa'aÕ ম্যাগাজিনে রাশেদ খলিফার গবেষণার খবর প্রথম প্রকাশ করে। একই পত্রিকায় নভেম্বর ২৮, ১৯৭৩ এবং ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭৫ সালে ঐ গবেষণার আপডেট প্রকাশ করা হয়। এরপর সারা বিশ্বেই বিভিন্ন ভাষার পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, বইয়ে রাশেদ খলিফা এবং তাঁর আবিষ্কারটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করা হয়।
১৯৭৯ সালের অক্টোবর মাসে ‘ইসলাম ধর্মের রসুল’ দাবিকারী রাশেদ খলিফার বিরুদ্ধে ১৬ বছরের এক মেয়েকে ‘যৌন নির্যাতন-নিপীড়ণ-উত্যক্ত’ করার অভিযোগ ওঠে। অভিযোগকারিণীর দাবি, জাতিসংঘের একটি গবেষণা প্রজেক্টে কাজ করার সময় রাশেদ খলিফা তাঁর উপর ‘যৌন নির্যাতন-নিপীড়ণ’ চালিয়েছেন।
১৯৮৪ সালে রাশেদ খলিফা আমেরিকার ÔNational Academy of ScienceÕ-এর বিরুদ্ধে ৩৮ মিলিয়ন ডলারের মামলা করেন ÔScience and CreationismÕ নামক বিবর্তনবাদের ওপর গ্রন্থ প্রকাশের জন্য, যে গªন্থে বলা হয়েছে, ÒEvolution is a Godless process.” পরবর্তীতে অবশ্য রাশেদ খলিফার এ মামলা কোর্টে টেকেনি।
১৯৯০ সালের ৩১ জানুয়ারি আমেরিকার এরিজোনা রাজ্যের টুকসন মসজিদের ভিতর ৫৪ বছর বয়সী রাশেদ খলিফার মৃতদেহ পাওয়া যায়। তাঁর সারা শরীরে ছুরি দিয়ে ২৯ বার জখম করা হয়েছিল এবং চেহারা এতই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে মুখমণ্ডল দেখে চেনাই যাচ্ছিল না। রাশেদের হত্যাকারী হিসেবে আমেরিকার ‘জামাতুল ফুরকা’ নামের একটি মুসলিম মৌলবাদী সংগঠনের দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠে।
কোরান সম্পর্কে রাশেদ খলিফার অভিমত হচ্ছে : “কোরান হলো আল্লাহর ‘ফাইনাল টেস্টামেন্ট’। নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর কোরানে মিথ্যা আয়াত ঢুকিয়ে বিকৃত করা হয়েছে, সময়ানুসারে কোরানের সুরা সাজানো হয়নি। খলিফা ওসমান কোরান সংকলনের জন্য যে কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন সাহাবিদের দিয়ে, তাঁরা ভুল করেছেন। হজরত আলী কোরান সংকলন কমিটির সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু কোরানকে বিকৃতির হাত থেকে রা করা যায়নি। তারপর ৬৭০ খ্রিস্টাব্দে মারওয়ান ইবনে আল হাকাম (মৃত্যু ৬৫ হিজরি/৬৮৪ খ্রিস্টাব্দ) হজরত ওমরের কন্যা হাফসার কাছে রতি নবী মুহাম্মদের নিজ হাতে লেখা ‘প্রকৃত কোরান’ ধ্বংস করে ফেলেন। আজকে সারা বিশ্বে মোটামুটি একই স্টান্ডার্ডের কোরান অনুসরণ করা হয়ে থাকে তা তৈরি হয়েছিল মিশরের কায়রোতে ১৯২৪ সালে। হজরত ওসমানের সময়কার সংকলিত কোরানের দুটি কপি পাওয়া গেছে উজবেকিস্তান (তাশখন্দ শহর) এবং তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহর থেকে; এগুলি থেকে দেখা গেছে এখানেও মনুষ্যকৃত ভুল রয়েছে। ১৯২৪ সালের মিশরীয় সংস্করণে তা শুদ্ধ করা হয়। এরপর সৌদি বাদশা ফাহাদ কোরানের আরেকটি সংস্করণ বের করেন। আজকে কোরানের সকল মাসহাফকে যে একই রকম বলে দাবি করা হয়, তা সত্য নয়। বিভিন্ন পার্থক্য নিয়ে পৃথক রকমের কোরানের অস্তিত্ব পৃথিবীতে ছিল।”[14] তাই বিকৃত হয়ে যাওয়া কোরানকে উদ্ধার করে মানুষের কাছে আল্লাহর প্রকৃত বাণী পৌঁছানোর জন্য নিজ উদ্যোগে রাশেদ কোরানের নতুন একটি অনুবাদ তৈরি করেন।
রাশেদ খলিফার কোরান সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য, নতুন ধর্মমত তৈরি, নিজেকে রসুল বানানোর প্রচেষ্টা ইত্যাদি স্পষ্টই ইসলামের মূল বিশ্বাসের পরিপন্থী হওয়া সত্ত্বেও উনিশ মিরাকল সম্পর্কে তাঁর উপস্থাপন ভঙ্গি চমৎকার। কোরানে মিরাকল রয়েছে বলে যে ‘হিসাব’ তিনি দেখিয়েছেন তা প্রথম দেখাতে মুসলমান-অমুসলমান অনেককেই বিভ্রান্ত করতে পারে। হুট করে এই মিরাকলের পিছনের কারিগরি বোঝা কারো কারো কাছে অসম্ভব। রাশেদ খলিফার কোরানের ১৯ মিরাকল নিয়ে বাংলা ভাষায় কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছে, যেমন : মেজর কাজী জাহান মিয়া লিখিত ‘আল-কোরআন দ্য চ্যালেঞ্জ’ নামক দুই খণ্ডের বইয়ের প্রথম খণ্ডের প্রথম চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে এই ১৯ মিরাকল।[15] লেখকের উচ্চ প্রশংসা করে বইটির প্রথমেই একটি অভিমত দিয়েছেন মাসিক মদীনা’র সম্পাদক, বাংলাদেশের বিশিষ্ট আলেম মাওলানা মুহিউদ্দীন। ডাঃ খন্দকার আব্দুল মান্নান লিখিত ‘কমপিউটার ও আল কুরআন’ নামক বইটিতে স্থান পেয়েছে ১৯-এর ম্যাজিক।[16] আল-কোরআন একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমদ কোরানের একটি বাংলা অনুবাদ করেছেন।[17] কোরানের বাংলা অনুবাদের প্রথমে তিনি রাশেদ খলিফার ১৯ ম্যাজিক হাজির করেছেন ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে। এছাড়া বিভিন্ন মফস্বল শহরের স্থানীয় পত্র-পত্রিকা, চটি বইয়ে এই ১৯ ম্যাজিকের গল্প বলা হয়েছে। আর বাংলাদেশের একটি মফস্বল শহরে বিজ্ঞান আন্দোলন করতে গিয়ে কতশত বার এই ‘১৯ ম্যাজিক’ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে তা আর বলার অপো রাখে না। আজকের এই প্রবন্ধটিতে ‘আল-কোরানের উনিশ ভোঁজাভাজি’ নির্মোহ দৃষ্টিতে বিচার করা হবে, যুক্তিবাদী মন নিয়ে উদ্ঘাটন করা হবে রাশেদ খলিফা ঘোষিত ‘কোরানের গ্রেট মিরাকল’ ৭৪:৩০ নং আয়াতের যথার্থতা।
রহস্যের চাবিকাঠি : কোরানের ৭৪:৩০ নং আয়াত
দাবি : “সুরা আল-মুদাচ্ছির (৭৪) এর ৩০ নম্বর আয়াতে আল-কোরানে উনিশ সংখ্যার ফর্মুলার কথা বলা হয়েছে।”
৭৪:৩০ নম্বর আয়াত : “আ’লাইহা তিসআ’তা আ’শারা”—অর্থাৎ ইহার উপর উনিশ। এ বাক্যাংশে ‘ইহার’ বা ‘তাহার’ কথাটি রয়েছে। এখন ‘ইহার’ বা ‘তাহার’ দ্বারা কি বা কাকে বোঝানো হচ্ছে জানতে হলে অবশ্যই এর আগের-পরের বাক্যগুলোতে ফিরে যেতে হবে, বিবেচনায় আনতে হবে। মনে রাখতে হবে এ আয়াতটি বিচ্ছিন্নভাবে নাযিল হয়নি। আর বিচ্ছিন্নভাবে কোনো একটা আয়াতকে এভাবে উপস্থাপন করলে কি দাড়ায়, দেখা যাক : ‘নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে।’ (১০৩:২)। এই আয়াতটি বিচ্ছিন্নভাবে উপস্থাপন করলে এর অর্থ যা দাঁড়ায় তা অর্থহীন এবং ঐ সুরার মূলভাবের সাথে সাংঘর্ষিক। এবার এর আগের ও পরের আয়াত দেখি : ‘শপথ যুগের, নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, তবে তারা ব্যতীত যারা ঈমান এনেছে।’ অর্থাৎ এখানে বোঝানো হচ্ছে সকল মানুষ নয় বরং যারা আল্লাহতে ঈমান আনেনি তারাই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত। এভাবে কোরানের আয়াতগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে উপস্থাপন করলে তা অনেক ক্ষেত্রে কোরানের মূলভাবের সাথে সাংঘর্ষিক, অবাস্তব, অর্থহীন, হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমরা যদি সুরা মুদাচ্ছিরের ৩০ নম্বর আয়াতটির অর্থ বুঝতে চাই তবে অবশ্যই এই আয়াতের আগের ও পরের আয়াত আমাদের বিবেচনায় আনতেই হবে।
আলোচনার সুবিধার্থে বিস্তারিতভাবে এখানে সুরা মুদ্দাচ্ছিরের ২৭-৩১নং আয়াত বিভিন্ন প্রসিদ্ধ অনুবাদকের অনুবাদ ও সেই সাথে বিভিন্ন প্রসিদ্ধ তফসিরকারকদের তফসির তুলে ধরা হলো :
(১) আল-কোরানের বিখ্যাত ইংরেজি অনুবাদক ইউসুফ আলী, পিকথাল, শাকীর সুরা মুদ্দাচ্ছিরের ২৭-৩১নং আয়াত অনুবাদ করেছেন এভাবে :
074.027
YUSUFALI: And what will explain to thee what Hell-Fire is?PICKTHAL: - Ah, what will convey unto thee what that burning is! –
SHAKIR: And what will make you realize what hell is?
074.028
YUSUFALI: Naught doth it permit to endure, and naught doth it leave alone!-PICKTHAL: It leaveth naught; it spareth naught
SHAKIR: It leaves naught nor does it spare aught.
074.029
YUSUFALI: Darkening and changing the colour of man!PICKTHAL: It shrivelleth the man.
SHAKIR: It scorches the mortal.
074.030
YUSUFALI: Over it are Nineteen.PICKTHAL: Above it are nineteen.
SHAKIR: Over it are nineteen.
074.031
YUSUFALI: And We have set none but angels as Guardians of the Fire; and We have fixed their number only as a trial for Unbelievers,- in order that the People of the Book may arrive at certainty, and the Believers may increase in Faith,- and that no doubts may be left for the People of the Book and the Believers, and that those in whose hearts is a disease and the Unbelievers may say, "What symbol doth Allah intend by this?" Thus doth Allah leave to stray whom He pleaseth, and guide whom He pleaseth: and none can know the forces of thy Lord, except He and this is no other than a warning to mankind.
PICKTHAL: We have appointed only angels to be wardens of the Fire, and their number have We made to be a stumbling-block for those who disbelieve; that those to whom the Scripture hath been given may have certainty, and that believers may increase in faith; and that those to whom the Scripture hath been given and believers may not doubt; and that those in whose hearts there is disease, and disbelievers, may say: What meaneth Allah by this similitude? Thus Allah sendeth astray whom He will, and whom He will He guideth. None knoweth the hosts of thy Lord save Him. This is naught else than a Reminder unto mortals.
SHAKIR: And We have not made the wardens of the fire others than angels, and We have not made their number but as a trial for those who disbelieve, that those who have been given the book may be certain and those who believe may increase in faith, and those who have been given the book and the believers may not doubt, and that those in whose hearts is a disease and the unbelievers may say: What does Allah mean by this parable? Thus does Allah make err whom He pleases, and He guides whom He pleases, and none knows the hosts of your Lord but He Himself; and this is naught but a reminder to the mortals.
ইংরেজি অনুবাদকগণ স্পষ্টই বলেছেন সুরা মুদ্দাচ্ছিরে ৩০নং আয়াতটিতে শুধুমাত্র দোজখের উনিশজন ফেরেশতার সংখ্যার কথাই বলা হয়েছে, এর বেশি কিছু নয়।
(২) উপমহাদেশের বিশিষ্ট আলেম মাওলানা আশরাফ আলি থানভী কর্তৃক রচিত ‘বয়ানুল কোরআন’-এর সংক্ষিপ্ত অনুবাদে রয়েছে[18] :
“আপনি জানেন কি দোজখ কি বস্তু? (২৭) উহা (কাহাকেও উহাতে প্রবেশ করার পর অদগ্ধ) থাকিতে দিবে না―এবং (অনাগত কোনও কাফেরকে বাহিরে) ছাড়িবে না। (২৮) উহা (পোড়াইয়া) দেহের সৌষ্ঠব বিকৃত করিয়া দিবে। (২৯) উহার উপর উনিশজন ফেরেশতা (নিযুক্ত) থাকিবেন। (৩০) আর আমি দোজখের কর্মচারী কেবল ফেরেশ্তাদিগকেই নিযুক্ত করিয়াছি। আর আমি তাহাদের সংখ্যা এইরূপে রাখিয়াছি যাহা কাফেরদের বিভ্রান্তির উপকরণ হয়, (আর এই জন্য) যেন বিশ্বাস করে―কিতাবীগণ এবং ঈমানদারদের ঈমাণ আরও বৃদ্ধি পায়। (৩১)।” (সুরা ৭৪, মুদ্দাচ্ছির, আয়াত ২৭-৩১)।
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এই সুরা মুদ্দাচ্ছিরের ৩০ নং আয়াতের অনুবাদে উল্লেখ করাই আছে: ‘উহার উপর উনিশজন ফেরেশতা (নিযুক্ত) থাকিবেন।’ অর্থাৎ দোজখের বর্ণনার মধ্যে যে ‘উনিশ’ রয়েছে তা কোনো কোরানের অলৌকিক ফর্মুলা বা কোনো কোড নয় বরং দোজখের শাস্তি প্রদানকারী উনিশজন ফেরেশতার কথা বলা হচ্ছে, যা ৩১নং আয়াত পড়লেই বুঝা সম্ভব।
এবার এই আয়াতগুলির শানে নুজুল লক্ষ্য করি :
“৩০নং আয়াতটি শ্রবণ করিয়া আবুল আসাদ নামক জনৈক শক্তিশালী কাফের বলিয়া উঠিল, হে কোরাইশ জাতি! তোমরা ইহাতে ভীত হইও না। আমি দশজন ফেরেশ্তাকে ডান বাহু দ্বারা এবং নয়জনকে বাম বাহু দ্বারা পরাজিত করিয়া দিব। অন্য রেওয়াতে আছে, এই আয়াতটি শুনিয়া আবু জাহাল বলিল, ভয় কিসের? ফেরেশ্তারা মাত্র উনিশজন। তোমরা সংখ্যায় অনেক রহিয়াছ। প্রতি দশজন মানুষও কি একজন ফেরেশ্তাকে হঠাইয়া দিতে পারিবে না? এই ঘটনা সম্পর্কে আয়াতটি নাজিল হয়। (দ্রষ্টব্য : ছহীহ রহমানী বঙ্গানুবাদ কোরআন শরীফ (বয়ানুল কোরআনের সংপ্তি অনুবাদ), পৃষ্ঠা ৯৪২)।
শানে-নুজুল থেকে এটা পরিষ্কার যে রাশেদ খলিফা প্রদত্ত ‘মিরাকল উনিশ’ আয়াতটিতে দোজখের শাস্তি প্রদানকারী উনিশজন ফেরেশতার কথাই বলা হয়েছে এবং এটা বলার জন্যই এ আয়াতগুলো রচিত হয়েছে।
এখানে একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, কোরানে যদি কোনও সংখ্যার ফর্মুলা (মিরাকল বা ম্যাজিক ইত্যাদি) থাকে তবে তা দোজখের মধ্যে বর্ণিত হবে কেন? এটা তো একটি সুসংবাদ, যা বেহেশতের বর্ণনাতে থাকাই স্বাভাবিক ছিল।
(৩) আলহাজ্জ মাওলানা এ, কে, এম, ফজলুর রহমান মুন্সী ‘বঙ্গানুবাদ কোরান শরীফ’-এ সুরা মুদ্দাচ্ছির-এর ২৭-৩১ নম্বর আয়াতের অনুবাদ করেছেন এভাবে[19] :
“(২৭) তুমি কি বুঝ?―এই ছাকার কি? (২৮) এমন আগুন―যা কিছুই বাকী রাখবে না, এবং ছাড়বেও না। (২৯) মানুষকে ঝলসে দেবে। (৩০) সেখানে উনিশ জন রয়েছে। (৩১) ফিরেশতাদের ছাড়া কাউকে জাহান্নামে মোতায়েন করিনি। আমি তাদের সংখ্যা স্থির করেছি-শুধু কাফিরদের পরীক্ষার জন্য!”
(৪) বাংলাদেশের বিশিষ্ট আলেম ও বহু গ্রন্থ-প্রণেতা মাওলানা মুহিউদ্দীন খান কর্তৃক অনূদিত ‘তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন’-এ সুরা মুদ্দাচ্ছিরের ২৭-৩১ নম্বর আয়াতের অনুবাদ করা হয়েছে এভাবে[20] :
“(২৭) আপনি কি বোঝলেন অগ্নি কি? (২৮) এটা অত রাখবে না এবং ছাড়বেও না। (২৯) মানুষকে দগ্ধ করবে। (৩০) এর উপর নিয়োজিত আছেন উনিশজন ফেরেশতা। (৩১) আমি জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতাই রেখেছি। আমি কাফেরদেরকে পরীক্ষা করার জন্যই তার এই সংখ্যা করেছি।”
এখানেও দেখা যাচ্ছে অনুবাদক স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছেন, এখানে ‘উনিশ’ দ্বারা কোনো ফর্মুলা নয় বরং উনিশজন ফেরেশতার কথা বলা হচ্ছে।
তফসীরকারক এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, “তফসীরবিদ মুকাতিল বলেন : এটা আবু জাহ্লের উক্তির জওয়াব। সে যখন কোরআনের এই বক্তব্য শুনল যে, জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক উনিশজন ফেরেশতা, তখন কোরায়শ যুবকদের সম্বোধন করে বলল : মুহাম্মদের সহচর তো মাত্র উনিশজন। অতএব, তার সম্পর্কে তোমাদের চিন্তা করার দরকার নেই। সুদ্দী বলেন : উপরোক্ত মর্মে আয়াত নাজিল হলে পর জনৈক নগণ্য কোরায়শ কাফের বলে উঠল : হে কোরায়শ গোত্র, কোন চিন্তা নেই। এই উনিশ জনের জন্যে আমি একাই যথেষ্ট, আমি ডান বাহু দ্বারা দশজনকে এবং বাম বাহু দ্বারা নয় জনকে দূর করে দিয়ে উনিশের কিস্সা চুকিয়ে দেব। এর পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং বলা হয় : আহাম্মকের স্বর্গে বসবাসকারীরা জেনে রাখ, প্রথমতঃ ফেরেশতা একজনও তোমাদের সবার জন্য যথেষ্ট। এখানে যে উনিশ জনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তারা সবাই প্রধান ও দায়িত্বশীল ফেরেশতা। তাদের প্রত্যেকের অধীনে কর্তব্য পালন ও কাফেরদেরকে আযাব দেয়ার জন্যে অসংখ্য ফেরেশতা নিয়োজিত আছেন, যাদের সঠিক সংখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না।” (দ্রষ্টব্য : তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন, পৃষ্ঠা ১৪২১)।
অর্থাৎ ‘উনিশ’ সংখ্যাটা যে ফেরেশতাদের সংখ্যা মাত্র তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
(৫) নাসিম উদ্দিন আহমদ কর্তৃক অনূদিত কোরান শরিফের বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদে ‘উনিশ’-এর ব্যাখ্যায় (পাদটীকায়) বলা হয়েছে[21]: ‘জাহান্নামের উনিশ জন রক্ষক।’—‘Nineteen guardians of the Fire.’
(৬) সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী-এর ‘তাফহীমুল কুরআন’-এ সুরা মুদ্দাচ্ছিরের ২৭-৩১ নম্বর আয়াত অনুবাদ করা হয়েছে[22]: “(২৭) আর তুমি কি জান, সেই দোযখটি কি? (২৮) উহা কাহাকে জীবিত রাখে না আবার মৃতাবস্থায়ও ছাড়িয়া দেয় না। (২৯) চামড়া ঝলসাইয়া দেয়। (৩০) ঊনিশজন কর্মচারী সেখানে নিয়োজিত। (৩১) আমরা উহা দোযখের এই কর্মচারী ফেরেশতাদিগকে বানাইয়াছি। আর তাহাদের সংখ্যাকে কাফিরদের জন্য একটা পরীা-মাধ্যম বানাইয়া দিয়াছি।”
তফসীরে বলা হয়েছে : “লোকেরা রাসূলে করীম (স)-এর মুখে শুনিতে পাইয়াছিল যে, দোযখের কর্মচারীর সংখ্যা হইবে মাত্র উনিশ জন। এই কথা শোনা মাত্রই তাহারা এই কথার উপর ঠাট্টা-বিদ্রুপ করিতে শুরু করিয়া দিয়াছিল। এমনকি, এই কথা শুনিয়া তাহারা বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গিয়াছিল। তাহাদের মনে প্রশ্ন জাগিয়াছিল যে, একদিকে আমাদিগকে বলা হইতেছে যে, আদম (আ) হইতে কিয়ামত পর্যন্ত দুনিয়ার যত মানুষ কুফরী ও নাফরমানী করিয়াছে তাহারা সকলেই দোযখে নিপ্তি হইবে। আবার সেই সঙ্গেই আমাদিগকে বলা হইতেছে যে, এতবড় একটা বিশাল-বিরাট দোযখে এত অসংখ্য মানুষকে আযাব দেওয়ার কাজে মাত্র ১৯ জন কর্মচারী নিযুক্ত করা হইবে! এই কথায় কুরাইশ সরদাররা প্রচণ্ড অট্টহাস্যে ভাঙিয়া পড়িল। আবূ জেহেল বলিল : ‘ভাই সব! তোমরা কি এতই দুর্বল ও অর্থব হইয়াছ যে, তোমরা দশ-দশ জন লোক মিলিয়াও দোযখের এক একজন কর্মচারী ও সিপাহীর মুকাবিলা করিতে পারিবে না?’ বনু জুমাহ গোত্রের একজন পাহলোয়ান বলিয়াই ফেলিল : ‘১৭ জনের সহিত তো আমি একাকীই মুকাবিলা করিব, অবশিষ্ট দুই জনকে তোমরা কাবু করিয়া লইবে।’ এই ধরনের অত্যন্ত হাস্যকর কথাবার্তার জওয়াবে এই বাক্যটি একটি মধ্যবর্তী কথা হিসাবে বলিয়া দেওয়া হইয়াছে।” (দ্রষ্টব্য : তাফহীমুল কুরআন, ১৮শ খন্ড, পৃষ্ঠা ১০৮)।
(৭) ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক কোরান শরিফের অনুবাদে সুরা মুদ্দাচ্ছির এর ২৭-৩১ নম্বর পর্যন্ত আয়াত অনুবাদ করা হয়েছে এ রকম[23]: “(২৭) তুমি কি জান সাকার কী? (২৮) উহা উহাদিগকে জীবিতাবস্থায় রাখিবে না ও মৃত অবস্থায় ছাড়িয়া দিবে না। (২৯) ইহা তো গাত্রচর্ম দগ্ধ করিবে। (৩০) সাকার-এর তত্ত্বাবধানে রহিয়াছে উনিশ জন প্রহরী। (৩১) আমি ফিরিশ্তাদিগকে করিয়াছি জাহান্নামের প্রহরী; কাফিরদিগের পরীক্ষা স্বরূপই আমি উহাদিগের এই সংখ্যা উল্লেখ করিয়াছি।”
(৮) সাইয়েদ কুতুব শহীদ এর বিশ্ববিখ্যাত তাফসীর ‘তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন’-এ এই আয়াতগুলো প্রসঙ্গে বলা হয়েছে[24] : “দোযখের প্রহরী থাকে ‘উনিশ জন’। এই ফেরেশতারা ব্যক্তি না গোষ্ঠী, তা আমরা জানি না।” (পৃষ্ঠা ২৩৩)। “মোশরেকরা যে উনিশ জনকে নিয়ে বাকবিতণ্ডা শুরু করেছিল তার রহস্য নিয়েই আয়াতটি শুরু হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আমি দোযখের দায়িত্বশীল হিসেবে ফেরেশতা ছাড়া আর কাউকে নিযুক্ত করিনি।” (পৃষ্ঠা ২৩৪)।
উপরোক্ত দীর্ঘ আলোচনা থেকে দেখলাম সকল ইসলামি চিন্তাবিদ, তফসীরকারকের মতানুসারে সুরা মুদ্দাচ্ছিরের ৩০ নম্বর আয়াতে বর্ণিত ‘উনিশ’ কোনো ফর্মুলা বা কোড নয়। বরং তা দ্ব্যার্থহীনভাবে দোজখের (সাকার) প্রহরী উনিশজন ফেরেশতার কথা বোঝাচ্ছে।
কোরানের সুরা সংখ্যা
দাবি : “কোরানের সুরা সংখ্যা ১১৪ যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য।”
বর্তমানে বহুল প্রচলিত কোরানের সুরা সংখ্যা ১১৪ হলেও অনেক ইসলামি চিন্তাবিদ খলিফা উসমানের ‘কোরান সংকলন কমিটি’ কর্তৃক প্রণীত কোরানের সুরা সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত প্রকাশ করে আসছেন। তাঁরা সুরা ফালাক ও নাস কোরানের অংশ বলে মনে করেন না। তারা বলেন : “একটা কেশে কয়েকটি গ্রন্থি দিয়ে, হজরত মোহাম্মদ মোস্তফার (স.) ন্যায় মহারাসুলের দিব্য জ্ঞানের বিকার ঘটানো যদি লাবীদের ন্যায় একজন নগণ্য ইহুদির পক্ষে সম্ভবপর হয়, তাহলে জগতের অভিধান হতে ‘অসম্ভব’ কথাটা চিরকালের জন্য মুছে যাওয়া উচিৎ। কোরানের একটি আয়াতে এই মতের সমর্থন হচ্ছে-সুরা ফোরকানে বর্ণিত হয়েছে ‘এবং অত্যাচারী (কাফের)গণ (মুসলমানদিগকে সম্বোধন করে) বলে, তোমরা তো একজন জাদু ও মায়াবিষ্ট লোকের অনুসরণ করছ মাত্র। দেখ, তারা তোমার সম্বন্ধে কিরূপ উপমার সৃষ্টি করেছে, এর ফলে তারা ভ্রষ্ট হয়ে গেল, সুতরাং তারা আর পথ পেতে সমর্থ হবে না।’ (১ম রুকু) এই আয়াত হতে স্পষ্ট জানা যাচ্ছে যে, ‘হজরতকে কেউ যে জাদু করেছে’, আরবের কাফেরগণই এরূপ কথা বলত। এই আয়াতে ঐ প্রকার উক্তির কঠোর প্রতিবাদ করে ঐ মিথ্যাপ্রচারকদিগকে অত্যাচারী ও ভ্রষ্ট বলা হচ্ছে। কোরানে ‘তা-হা’ সুরায় হজরত মুসা এবং ফেরআওনের জাদুকরদিগের ঘটনা বর্ণনার পর বলা হয়েছে-জাদুকরগণ কুত্রাপি সফলতা লাভ করতে পারে না।”[25]
অর্থাৎ হজরত মুহাম্মদকে জাদু করা হয়েছিল এবং এ জাদু থেকে মুক্তি লাভের উপায় হিসেবে সুরা ফালাক ও সুরা নাস নাজিল হয়েছে, এমন ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়। মাওলানা আকরাম খাঁ হজরত মোহাম্মদ (দ.)-এর ওপর জাদুর প্রভাব হওয়া সম্পর্কে বলছেন : “এই সুরা দুটিকে (ফালাক ও নাস) অবলম্বন করে বিভিন্ন প্রকারের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়ে গেছে। সাহাবী আব্দুল্লাহ এবন-মাছউদ এ সুরা দুটিকে কোরানের অংশ বলে স্বীকার করেননি। নিজের মুসাবিদায় সুরা দুটি লিপিবদ্ধ করেননি এবং সমস্ত সাহাবীর মতের ও স্পষ্ট হাদিসগুলোর বিরুদ্ধে আজীবন দৃঢভাবে নিজের মত কায়েম রেখেছেন।” (দ্রষ্টব্য : ইসলামী দর্শন ও দার্শনিক, পৃষ্ঠা ১৯৪)। তাহলে সুরা ফালাক ও নাসকে সঙ্গত কারণেই বর্জন করে আমরা কোরানের সুরা সংখ্যা ১১২টি বলতে পারি।
সুরা ‘ফাতিহা’ কি কোরানের অংশ, এ নিয়ে অনেক মুসলমানের মধ্যে সংশয়-দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। এ প্রসঙ্গে যুক্তি হচ্ছে, সুরা ফাতিহা পাঠে বুঝা যায় এটা আল্লাহর কথা নয়, এটা মানুষের কথা; আল্লাহ কখনো বলবেন না, ‘আমাকে সরল পথ দেখাও’ অথবা ‘আমি শুধু তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই।’
নবম সুরা ‘তওবা’ সম্পর্কে মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রচিত বয়ানুল কোরানে রয়েছে : “এই সুরাটি ইহার পূর্ববর্তী সুরা সুরায়ে আনফালের অংশ হওয়ার এবং স্বতন্ত্র সুরা না হওয়ার সম্ভাবনা রহিয়াছে, এই অনিশ্চয়তার দরুন ইহার প্রথমে বিসমিল্লাহ লেখা হয় নাই।” (দ্রষ্টব্য : ছহীহ রহমানী বঙ্গানুবাদ কোরআন শরীফ (বয়ানুল কোরআনের সংপ্তি অনুবাদ), পৃষ্ঠা ৩০৩)। এ প্রসঙ্গে তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন-এ উল্লেখ আছে : “একটি সূরা সমাপ্ত হওয়ার পর দ্বিতীয় সূরা শুরু করার আগে ‘বিসমিল্লাহির রাহ্মানির রাহীম’ নাযিল হত। এর থেকে বোঝা যেত যে, একটি সূরা শেষ হত, অতঃপর অপর সূরা শুরু হল। কোরআন মজীদের সকল সূরার বেলায় এ নীতি বলবৎ থাকে। সূরা তওবা সর্বশেষ নাজিলকৃত সূরাগুলোর অন্যতম। কিন্তু সাধারণ নিয়ম মতে এর শুরুতে না বিসমিল্লাহ নাযিল হয়, না রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তা লিখে নেয়ার জন্যে ওহী লেখকদের নির্দেশ দেন। এমতাবস্থায় হযরত (সাঃ)-এর ইন্তেকাল হয়। কোরআন সংগ্রাহক হযরত ওসমান গনী (রাঃ) স্বীয় শাসনামলে যখন কোরআনকে গ্রন্থের রূপ দেন, তখন দেখা যায়, অপরাপর সুরার বরখেলাফ সুরা তওবার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ্’ নেই। তাই সন্দেহ ঘনীভূত হয় যে, হয়তো এটি স্বতন্ত্র কোন সুরা নয় বরং অন্য কোন সুরার অংশ। এতে এ প্রশ্নের উদ্ভবও হয় যে, এমতাবস্থায় তা কোন সুরার অংশ হতে পারে? বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে একে সুরা আনফালের অংশ বলাই সংগত।” (দ্রষ্টব্য : তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন, পৃষ্ঠা ৫৫২)।
“সূরা তওবা স্বতন্ত্র সূরা না হয়ে সূরা আনফালের অংশ হওয়ার সম্ভাবনাটি এর শুরুতে বিসমিল্লাহ্ না লেখার কারণ, এ সম্ভাবনা থাকার ফলে এখানে বিসমিল্লাহ্ লেখা বৈধ নয়, যেমন বৈধ নয় কোন সুরার মাঝখানে বিসমিল্লাহ লেখা।” (দ্রষ্টব্য : তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন, পৃষ্ঠা ৫৫৩)।
তাহলে সুরা তওবা ও সুরা আনফাল একই সুরার অংশ না-কী দুটি ভিন্ন সুরা তা অমীমাংসিত।
সুরা ফীল ও সুরা কোরাইশ নিয়েও রয়েছে এরকম বির্তক। তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন-এর ১৪৭৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে : “এ ব্যাপারে সব তফসীরকারকই একমত যে, অর্থ ও বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে এই সূরা (কোরাইশ) সূরা-ফীলের সাথেই সম্পৃক্ত। সম্ভবতঃ এ কারণেই কোন কোন মাসহাফে এ দু’টিকে একই সূরারূপে লেখা হয়েছিল। উভয় সূরার মাঝখানে বিসমিল্লাহ লিখিত ছিল না। কিন্তু হযরত ওসমান (রাঃ) যখন তাঁর খেলাফতকালে কোরআনের সব মাসহাফ একত্রিত করে একটি কপিতে সংযোজিত করান এবং সাহাবায়ে-কেরামের তাতে ইজমা হয়, তখন তাতে এ দু’টি সূরাকে স্বতন্ত্র দু’টি সূরারূপে সন্নিবেশিত করা হয় এবং উভয়ের মাঝখানে বিসমিল্লাহ্ লিপিবদ্ধ করা হয়। হযরত ওসমান (রাঃ)-এর তৈরি এ কপিকে ‘ইমাম’ বলা হয়।” অর্থাৎ সুরা ফীল ও সুরা কোরাইশ একই সুরা না-কী দুটি ভিন্ন সুরা তা নিয়ে অনেক সন্দেহের অবকাশ আছে।
উপরোক্ত আলোচনা হতে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, কোরানের সুরা সংখ্যা যেমন হতে পারে ১১৪টি, তেমনি তা হতে পারে ১০৯, ১১০, ১১১, ১১২ বা ১১৩টি এবং সবগুলোর পইে দৃঢ প্রমাণ রয়েছে; এবং এগুলো কোনোটাই (১১৪ ব্যতীত) ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়। তাই যারা কোরানের সুরা সংখ্যা ১১৪টি বলেন এবং একে স্থির ধরে শুধুমাত্র ১৯ দিয়ে বিভাজ্যতার কারণে এর পিছনে অলৌকিকত্ব খুঁজেন তাদের এ ধরনের অপচেষ্টার অসৎ উদ্দেশ্য বুঝতে কারও আর বাকি থাকে না।
কোরানের আয়াত সংখ্যা
দাবি : “কোরানের আয়াত সংখ্যা ৬৩৪৬, যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য (১৯×৩৩৪=৬৩৪৬) এবং এ সংখ্যাটির অঙ্কগুলোর যোগফল ১৯ (৬+৩+৪+৬=১৯)।”
মিশরীয় বংশোদ্ভূত রাশেদ খলিফার আবিষ্কৃত ‘উনিশ সংখ্যার মোজেযা’র অনেক একনিষ্ঠ অনুরাগী বাংলাদেশে আছেন। তাঁরা কেউবা ‘কোরানিক ১৯ সংখ্যার’ মিরাকলে আপ্লুত হয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন কোরানিক মিরাকল প্রচারের জন্য, কেউবা ওপেন চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করেছেন কোরানকে ‘অলৌকিক’ দাবি করে। বাংলাদেশে এরকম একজন অনুরাগী হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমদ। তিনি নিজেও কোরান বাংলাতে অনুবাদ করেছেন। আমরা হিসেব করে দেখেছি তাঁর অনূদিত কোরানে আয়াত সংখ্যা ৬২৩৭; যা ১৯ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য নয়। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের অনূদিত কোরানের সরল বঙ্গানুবাদেও একই সংখ্যক আয়াত রয়েছে। ইউসুফ আলীর অনূদিত কোরানের আয়াত সংখ্যা ৬২৩৯। মুনির উদ্দীন কি জানতেন রাশেদ খলিফা কোরানের নিজস্ব অনুবাদের নবম সুরা তওবা’তে শেষের দুটি আয়াত (১২৮ ও ১২৯) কেটে বাদ দিয়েছেন? কারণ (তাঁর মতে): “উক্ত আয়াত দুটি মিথ্যা। সুরা তওবা মদিনাতে নাযিল হয়েছিল আর ঐ শেষের আয়াত দুটি অনেক আগে মক্কায় থাকতে বলা হয়েছিল। তাহলে এই আয়াত দুটি সুরা তওবার শেষে গেল কিভাবে? আবার এই আয়াতের সাী হিসেবে দুজনের কথা জানা যায়, যারা তেমন বিশ্বাসযোগ্য নন।”[26] ইউসুফ আলী, পিকথাল, শাকীরসহ স্বনামধন্য কোরানের ইংরেজি অনুবাদক সুরার তওবা’র আয়াত সংখ্যা ১২৯ দিয়েছেন। তাদের অনূদিত আয়াত দুটি নীচে তুলে দেওয়া হলো[27] :
009.128
YUSUFALI: Now hath come unto you a Messenger from amongst yourselves: it grieves him that ye should perish: ardently anxious is he over you: to the Believers is he most kind and merciful.
PICKTHAL: There hath come unto you a messenger, (one) of yourselves, unto whom aught that ye are overburdened is grievous, full of concern for you, for the believers full of pity, merciful.
SHAKIR: Certainly a Messenger has come to you from among yourselves; grievous to him is your falling into distress, excessively solicitous respecting you; to the believers (he is) compassionate,
009.129
YUSUFALI: But if they turn away, Say: "Allah sufficeth me: there is no god but He: On Him is my trust,- He the Lord of the Throne (of Glory) Supreme!"PICKTHAL: Now, if they turn away (O Muhammad) say: Allah sufficeth me. There is no Allah save Him. In Him have I put my trust, and He is Lord of the Tremendous Throne.
SHAKIR: But if they turn back, say: Allah is sufficient for me, there is no god but He; on Him do I rely, and He is the Lord of mighty power.
রাশেদ খলিফার অনূদিত কোরানে নবম সুরা তওবা’র আয়াত সংখ্যা ১২৭টি।[28] হাফেজ মুনির উদ্দীনের কোরানেও সুরা তওবার শেষের আয়াত দুটি আছে : “(১২৮) (হে মানুষ,) তোমাদের কাছে তোমাদেরই মধ্য থেকে এক রসূল এসেছে, তোমাদের কোনরকম কষ্ট ভোগ তার কাছে দুঃসহ, সে তোমাদের একান্ত কল্যাণকামী, ঈমানদারদের প্রতি সে হচ্ছে øেহপরায়ণ ও পরম দয়ালু। (১২৯) এরপরও যদি এরা (এমন কল্যাণকামী একজন রসূলের কাছ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তুমি (তাদের খোলাখুলি) বলে দাও, আল্লাহতায়ালাই আমার জন্যে যথেষ্ট, তিনি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই; (সমস্যায় সংকটে) আমি তাঁর ওপরই ভরসা করি এবং তিনিই হচ্ছেন মহান আরশের একচ্ছত্র অধিপতি।”
রাশেদ খলিফা যে কোরানকে ‘আল্লাহর বাণী’ বলে দাবি করলেন এবং সেই কোরানই তাঁর মতে মানুষের হস্তক্ষেপের ফলে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। তাই বিকৃতি থেকে উদ্ধারের জন্য দুটি আয়াত কেটে কমিয়ে নিজেই নতুন করে ইচ্ছে মত কোরান অনুবাদ করছেন। পনেরশত বছর পর এই ধরনের অভিযানের শুদ্ধতা-উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠতে পারে। তবে মূলে যে রহস্য লুকিয়ে রয়েছে তা হল এ রকম না হলে কোরানের অলৌকিকতা, ‘১৯ মিরাকল’ দেখানো যাচ্ছে না।
হাফেজ মুনির উদ্দীন কোরানে আয়াত সংখ্যার যে হিসাব দিয়েছেন, তা হলো : “হজরত আয়েশা (রা.)-এর মতে ৬৬৬৬, হজরত ওসমান (রা.)-এর মতে ৬২৫০, হজরত আলী (রা.)-এর মতে ৬২৩৬, হজরত ইবনে মাসউদ (রা.)-এর মতে ৬২১৮, মক্কার গণনা মতে ৬২১২, বসরার গণনা মতে ৬২২৬, ইরাকের গণনা মতে ৬২১৪। ঐতিহাসিকদের মতে হজরত আয়েশার (রা.) গণনাই বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।” ( দ্রষ্টব্য : কোরআন শরীফ: সহজ সরল বাংলা অনুবাদ, পৃষ্ঠা ১১)।
দেখা যাচ্ছে কোথাও (রাশেদ খলিফা প্রদত্ত) কোরানের আয়াত সংখ্যা ৬৩৪৬ বলা হয় নাই।
এ. বি. এম. আব্দুল মান্নান মিয়া ও আহমদ আবুল কালাম কোরানের আয়াত সংখ্যার বিষয়ে যে অভিমত দিয়েছেন তা এরকম[29] : “কোরানের আয়াত সংখ্যা ছয় হাজারের মত। শায়খ আদ-দানী (রা.) বলেছেন, মুসলিম উম্মাহ একমত যে কোরানের আয়াত সংখ্যা মোটামুটি ছয় হাজারের মত। তবে তাঁদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে এই ছয় হাজারের পরে কত সংখ্যা বেশি আছে তা নিয়ে। এ বিষয়ে ছয়টি মত পাওয়া যায় :
১. পূর্ণ ছয় হাজার; না বেশি, না কম।
২. ৬ হাজার ২শত ৪টি।
৩. ৬ হাজার ২শত ১৪টি।
৪. ৬ হাজার ২শত ১৯টি।
৫. ৬ হাজার ২শত ২৫টি।
৬. ৬ হাজার ২শত ৩৬টি।
এ বিষয়ে আরও কয়েকটি মত পাওয়া যায়। যথা―
৭. মুসনাদ দায়লামীর এক বর্ণনায় আছে কোরানের আয়াত সংখ্যা ৬ হাজার ২শত ১৬টি।
৮. ইবনুদ দুরীস (রা.)-এর এক বর্ণনায় জানা যায় কোরানের আয়াত সংখ্যা ৬ হাজার ৬শত।
৯. আমাদের দেশে ও অন্যান্য মুসলিম বিশ্বে বহুল প্রচলিত কোরানের আয়াত সংখ্যা ৬ হাজার ৬শত ৬৬টি।
কোরানের আয়াত সংখ্যা নির্ণয়ে এ মতবিরোধ খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। একটি উদাহরণের মধ্য দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠবে। সুরা ফাতিহার আয়াত সংখ্যা সাধারণভাবে গণ্য করা হয় ৭টি। কিন্তু ইমাম হাসান (রা.)-এর মতে আয়াত সংখ্যা ৮টি। তিনি ‘বিসমিল্লাহ’-কেও একটি আয়াত গণ্য করেছেন। আবার কারও কারও মতে সুরা ফাতিহার আয়াত সংখ্যা ৬টি। এ মতানুযায়ী ৬ ও ৭ আয়াতদ্বয় মিলে এক আয়াত এবং বিসমিল্লাহ আয়াত নয়। আবার কার কারও মতে সুরা ফাতিহার আয়াত সংখ্যা ৯টি।
তবে বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত কোরানের প্রতিটি সুরার প্রারম্ভে প্রতিটি সুরার যে আয়াত সংখ্যা উল্লেখিত আছে তা এক সঙ্গে যোগ করা হলে মোট আয়াত সংখ্যা দাঁড়ায় ৬২৩৬টি আর ‘বিসমিল্লাহ’-কে প্রতিটি সুরার এক একটি আয়াত গণ্য করা হলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৬২৩৬+১১৩ = ৬৩৪৯টি।”
পৃথিবীর এতো জ্ঞানী-গুণী ইসলামি পণ্ডিত থেকে শুরু করে আলেম-ওলামা-মাওলানা কেউই কোরানের আয়াত সংখ্যা ৬৩৪৬ বলেননি। যা রাশেদ খলিফা ‘কোরানের মিরাকল’ প্রমাণের জন্য উপস্থাপন করেছেন। আমরা কি বলতে পারি রাশেদ খলিফা সম্পূর্ণ স্বীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য অযৌক্তিকভাবে কোরানের আয়াত সংখ্যার মনগড়া হিসাব দাখিল করেছেন; যেমন করে তিনি নিজের অনূদিত কোরানের সুরা ফুরকানের ৫৬ নম্বর আয়াত, সুরা ইয়াসিনের ৩ নম্বর আয়াত, সুরা শুরা’র ২৪ নম্বর আয়াতে এবং সুরা তাক্ভির’র ২২ নম্বর আয়াতে ব্রাকেটে নিজের নাম ‘রাশেদ’ ঢুকিয়ে দিয়েছেন নিজেকে ‘রসুল’ হিসেবে প্রমাণের জন্য। দ্বিতীয় আরেকটি প্রশ্ন, বাংলাদেশে মেজর জাহান মিয়া, হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমদের মত ইসলামি পণ্ডিতরা কি বহুল প্রচলিত কোরানের আয়াত সংখ্যার সাথে রাশেদ খলিফা কৃত কোরানের আয়াত সংখ্যার গরমিল বা আয়াত কেটে কমিয়ে দেওয়া সম্পর্কে অবগত ছিলেন না? অবগত থাকলে, তবে কেন এই ধরনের গরমিল নিয়ে ‘কোরানের মিরাকল’ প্রমাণের অপচেষ্টায় সামিল হলেন? আবার জানা না থাকলে, কোনো ব্যক্তির ‘মিরাকল থিওরি’ নিয়ে নিজেই পূর্ণ তথ্য না জেনে কি কারণে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করছেন? অর্থাৎ ‘মিরাকল-ফেরিওয়ালা’র মত তাঁরাও এর দায়ভার এড়াতে পারেন না।
কোরানে ‘বিসমিল্লাহ’ ও তার বর্ণ সংখ্যা
দাবি : “কোরানে ‘বিসমিল্লাহ’ ১১৪ বার এসেছে যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য হয়। এছাড়া ‘বিসমিল্লাহ’-তে ১৯টি বর্ণ রয়েছে।”
বর্তমানে কোরানে যুক্ত জের-জবর-পেশ-তাশদীদ-মদ ইত্যাদি মুহাম্মদের কোরানে অস্তিত্ব ছিল না। হজরত ওসমান কর্তৃক সংকলিত-সম্পাদিত কোরানেও সমরূপ ব্যঞ্জনবর্ণকে আলাদা করে পাঠ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। স্বরবর্ণের ব্যবহার ছিল না। সকলেই জানেন, আরবি বর্ণমালায় ২৯টি বর্ণ রয়েছে; এর মধ্যে ২৬টি বর্ণ বর্তমানে ব্যঞ্জনবর্ণ রূপে গণনা করা হয় এবং বাকি তিনটি বর্ণ (আলিফ, ওয়াও, ইয়া) স্বরবর্ণ হিসেবে গণনা করা হয়। কিন্তু স্বরবর্ণ তিনটি প্রথমে ব্যঞ্জনবর্ণরূপেই ধরা হত; পরে ‘আলিফ, ওয়াও, ইয়া’ তিনটি ব্যঞ্জনবর্ণ স্বরবর্ণরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালেকের (মৃত ৭০৫) সময় গভর্নর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ কোরানের পঠন-লিখনের এ সমস্যা দূর করার জন্য প্রথম ইরাকের বসরা নগরীর সুফি পণ্ডিত হাসানকে অনুরোধ করেন। হাসান জনৈক বসরাবাসী ইয়াহিয়া ইবনে ইয়ামারকে নিয়োগ করেন। ইয়াহিয়াই প্রথমে সিরিয়ান ভাষায় ব্যবহৃত স্বরচিহ্ন এবং নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টানদের মধ্যে প্রচলিত ডট পদ্ধতির ব্যবহার আরবি বর্ণলিপিতে শুরু করেন; হ্রস্ব ও দীর্ঘ স্বরবর্ণের পার্থক্য, যুক্ত-ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণ, ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে যে সমরূপতা ছিল তার পার্থক্য ও শব্দ নির্ধারণ করেন। এরপর ধীরে ধীরে একটি বাক্যে শব্দের মধ্যে বিভক্তি, কমা, পূর্ণ ছেদ, সেমিকোলন, কোলন ইত্যাদি বিরামচিহ্ন ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু আরবি বর্ণলিপি বা লিখন পদ্ধতিতে এই নতুন জিনিশ আমদানি সর্বজন কর্তৃক গৃহীত হয়নি। কট্টরপন্থীদের আপত্তি ছিল ঐসব ডট ও স্বরচিহ্ন পবিত্র কোরানের ওহি নয়, এগুলো বিধর্মীদের তৈরি। বিখ্যাত সুন্নি নেতা মালিক ইবনে আনাস (মৃত ৭৯৫) মসজিদে এই ‘সংশোধিত কোরান’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। স্থানীয় আলেম-ওলামা, বাদশাহ একমত হয়ে বললেন, পূর্বের ‘চিহ্নহীন’ কোরানই থাকুক যেমন সিনাগগে (ইহুদিদের উপাসনালয়) তোরাহ রয়েছে। ইহুদি থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমান মনীষী হারুন ইবনে মুসা (মৃত ৮১৩) সর্বপ্রথম আরবি শব্দ ভাণ্ডার প্রস্তুত করেন। এরপর পুনরায় আব্বাসীয় খলিফা ইবনে মুজাহিদ (মৃত ৯৩৬) কোরানের পঠন পদ্ধতি, উচ্চারণ, বিরাম চিহ্ন ইত্যাদির ব্যবহার শাস্ত্রসম্মত বলে স্বীকৃতি প্রদান করেন। কিন্তু এই গোলমেলে পরিস্থিতির এখনো পূর্ণ সমাধান হয়নি। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে তুরস্কের ইস্তাম্বুল ও মিশরের কায়রো থেকে প্রকাশিত কোরানের আবৃত্তি পদ্ধতি মোটামুটি সর্বজনসম্মত হলেও স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের পঠন পার্থক্য আগের মতোই রয়ে গেছে।[30]
এবার মূল আলোচনায় যাই। ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ অর্থ ‘পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।’ স্পষ্টই এ কথাটি একজন মানুষ বলবে, আল্লাহ নয়; কারণ মুসলমানরা কোরানকে আল্লাহর বাণী বলে মনে করেন। তাই ‘বিসমিল্লাহ’ কোরানের অংশ হতে পারে না। অনেকে মনে করেন, ‘বিসমিল্লাহ’ কোরানের অংশ না হলেও হজরত মুহাম্মদ কোরান পাঠের আগে বা নির্দিষ্ট অংশ শুরু করার আগে ‘বিসমিল্লাহ’ বলতেন, যা সাহাবিরা অনুসরণ করতেন। ফলে এই ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দটি কোরানের সাথে জড়িয়ে পড়ে। আর ‘বিসমিল্লাহ’-এর অর্থ যেহেতু ‘পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি’, তাই এর দ্বারা বোঝা যায় কোরান পাঠ এখনো শুরু হয় নাই, ‘বিসমিল্লাহ’ এর পরই তা শুরু হতে যাচ্ছে।
তফসীর ‘মাআরেফুল ক্বোরআন’-এ বলা হয়েছে : “‘বিসমিল্লাহ’ কোরান শরিফের সূরা নামলের একটি আয়াত বা অংশ। সূরা তওবা ব্যতীত প্রত্যেক সূরার প্রথমে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা হয়। ‘বিসমিল্লাহ’ সূরা আল-ফাতিহার অংশ, না অন্যান্য সকল সূরারই অংশ, এতে ইমামগণ ভিন্নভিন্ন মত পোষণ করেছেন। ইমাম আবু হানিফা (রাহঃ) বলেছেন, ‘বিসমিল্লাহ’ সুরা নামল ব্যতীত অন্য কোন সূরার অংশ নয়।” (পৃষ্ঠা ২)।
আমরা পূর্বের আলোচনা থেকে দেখেছি সুরার সংখ্যা ১০৯, ১১০, ১১১, ১১২, ১১৩ বা ১১৪ এর মধ্যে যে কোনোটিকেই ধরে নেয়া যেতে পারে। সুরা ‘তওবা’ বাদে বাকি সুরার প্রারম্ভের ‘বিসমিল্লাহ’ বিবেচনায় আনলে এবং এর সাথে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে সুরা নমলের ৩০ তম আয়াতে উল্লেখকৃত ‘বিসমিল্লাহ’-কে যোগ করলে আমরা মোট ‘বিসমিল্লাহ’র সংখ্যা যেমন পেতে পারি ১১৪টি, তেমনি ১১০, ১১১, ১১২ ও ১১৩টিও পেতে পারি, যাদের কোনোটিই (১১৪ বাদে) ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়।
তাই কোরানে ‘বিসমিল্লাহ’ ১১৪ বার আছে এবং একে স্থির বলে ধরে নিয়ে তার মাঝে ‘মোজেযা’ খোঁজা শুধু অযৌক্তিক নয়, হাস্যকরও বটে।
ইসলামি ভাষ্য মতে, ‘কোরান আল্লাহর কাছ থেকে জিব্রাইল মারফত অথবা অন্য কোনো উপায়ে মৌখিকভাবে নাজিল হয়েছে, কোনো লিখিত দলিল আল্লাহর কাছ থেকে আসেনি।’ তাই কোরানের কোনো একটি বাক্যে কতটি বর্ণ আছে তা হিসেব করতে হলে মৌখিকভাবে উচ্চারিত বর্ণগুলো হিসেবে আনতে হবে, উহ্য যেসব বর্ণ লেখার সময় আসে, সেগুলো হিসেবে আনা ঠিক হবে না। যাহোক, এভাবে হিসেব করলে ‘বিসমিল্লাহ’র বর্ণ সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩টি। যেসব বর্ণ (যেমন) দুবার উচ্চারিত হয়েছে (তাশদীদযুক্ত হরফ) সেগুলোকে দুবার গণনা করলে দাঁড়ায় ১৬টি। খাড়া জবর যা আলিফের প্রতিনিধিত্ব করে তা হিসেবে আনলে মোট বর্ণ সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮টি।
এবার ‘বিসমিল্লাহ’র লিখিত রূপটিও যদি বিবেচনায় আনা যায় তবে তাশদীদযুক্ত হরফ যেহেতু দুবার উচ্চারিত হয় তাই এগুলোকে দুইবার উল্লেখিত ধরলে ‘বিসমিল্লাহ’র মোট বর্ণ সংখ্যা হয় ২২টি। সেই খাড়া জবরদ্বয় যা আলিফের প্রতিনিধিত্ব করে তা হিসেব করলে মোট বর্ণের সংখ্যা হয় ২৪টি (যেহেতু বিসমিল্লায় তাশদীদযুক্ত লামের পূর্বে একটি উহ্য লাম রয়েছে তাই তাশদীদযুক্ত লামকে একবার গণনা করলে হিসাবটি দাঁড়ায় যথাক্রমে ২১ ও ২৩); আর এক্ষেত্রে তাশদীদযুক্ত হরফগুলো একবার গণনা করলে দাঁড়ায় ২১টি। আর যদি আমরা তাশদীদযুক্ত হরফগুলোকে একবার গণনা করি আর খাড়া জবরকে বিবেচনায় না আনি এবং উচ্চারণে উহ্য বর্ণগুলোকেও হিসেবে আনি তবেই কেবল ‘বিসমিল্লাহ’র মোট বর্ণ সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯। তাই এ হিসেবকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার কিছুই নেই।
এখানে আরেকটি কথা গুরুত্বপূর্ণ, আরবি ভাষার বর্ণসংখ্যা গণনা পদ্ধতি ও লেখার পদ্ধতি নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে যার ফলে কোরানের বর্ণ সংখ্যার হিসাব সম্পর্কে কখনোই নিশ্চিত হওয়া যায় না। কোরান বিশেষজ্ঞরা কোরানের বর্ণ সংখ্যা গণনার ক্ষেত্রে খুবই দ্বিধাবিভক্ত।
রাশেদ খলিফা শুধু ‘বিসমিল্লাহ’র বর্ণ সংখ্যার মধ্যে অলৌকিকতা খোঁজার চেষ্টা করেননি, ‘বিসমিল্লাহ’র অন্তর্ভূক্ত শব্দগুলোর মধ্যে অলৌকিকতা খোঁজে পেয়েছেন। তিনি বলেন : “কোরানে ‘ইসম’ শব্দটি ১৯ বার, ‘আল্লাহ’ শব্দ ২৬৯৮ বার, ‘আর রাহমান’ শব্দ ৫৭ বার এবং ‘আর রাহিম’ ১১৪ বার রয়েছে যাদের সবগুলোই ১৯ দিয়ে বিভাজ্য।”
১৯৮৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ‘The Muslim Digest’ (জুলাই-অক্টোবর সংখ্যা) পত্রিকা রাশেদ খলিফার ‘গাণিতিক চালাকি’কে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে ‘অনিষ্টকর উৎপথগামী’ (sinister heretic) বলে মন্তব্য করেছে। তারা বলছেন : “রাশেদ খলিফার দাবি মতো কোরানে ‘আল্লাহ’ শব্দের সংখ্যা ২৬৯৮ নয়, এটি ২,৮১১ বার; আর-রাহমান ৫৭ বার নয় বরং এটি ১৬৯ বার এসেছে।” পূর্বেও ঐ পত্রিকা (জুলাই/আগস্ট, ১৯৮১ এবং মার্চ/এপ্রিল, ১৯৮২ সংখ্যা) রাশেদ খলিফার কোরান নিয়ে ভুলভাবে ‘মিরাকল’ উপস্থাপনের জন্য সমালোচনা করেছে।
কোরানে ‘বিসম’ শব্দটি ৩ বার, আলাদাভাবে ‘ইসম’ শব্দটি ১৯ বার এবং ‘ইসমুহু’ শব্দটি এসেছে ৫ বার। তাই ‘ইসম’ মোট ২৭ বার। বহুবচনরূপে ‘ইসম’ শব্দটি এসেছে ১২ বার; অর্থাৎ মোট ৩৯ বার ‘ইসম’ শব্দটি কোরানে এসেছে যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়। ‘বিসম’ ও ‘ইসমুহু’-এর সাথের ‘ইসম’ শব্দটি রাশেদ খলিফা তাঁর ‘১৯ মিরাকল’-এ হিসেব করেননি অথচ ‘লিল্লাহ’-তে অন্তর্ভূক্ত ‘আল্লাহ’ শব্দটি হিসেব করেছেন। কিন্তু কেন? কারণ এটি না করলে তাঁর ‘১৯ মিরাকল’-এর মিরাকল আর থাকছে না। আবার ‘আর রাহিম’ শব্দটি কোরানে ১১৪ বার রয়েছে, সেটি সত্য নয়। ‘আর রাহিম’ কোরানে এসেছে মোট ১১৬ বার (একবার বহুবচনে) যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়।[31]
কোরানের বর্ণ ও শব্দ সংখ্যা
দাবি : কোরানের সর্বমোট বর্ণসংখ্যা ৩২৯১৫৬, যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য (১৯×১৭৩২৪=৩২৯১৫৬)।
“সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে হযরত আবুদাল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-ও কোরআনের অর গণনা করেছেন বলে অনেকে মনে করেন। তাঁর গণনা মতে কোরআনের অর হচ্ছে ৩,২২,৬৭১। তাবেয়ীদের মাঝে মোজাহেদ (র.)-এর গণনা অনুযায়ী কোরআনের অর হচ্ছে ৩,২১,১২১। তবে সাধারণভাবে ৩,২০,২৬৭ সংখ্যাটিই বেশী প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।” (দ্রষ্টব্য : কোরআন শরীফ: সহজ সরল বাংলা অনুবাদ, পৃষ্ঠা ১১)। উল্লেখিত কোরানের তিনটি বর্ণ সংখ্যার কোনোটিই ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়। আর সাহাবায়ে কেরামরা কেউই রাশেদ খলিফা প্রদত্ত কোরানের বর্ণসংখ্যার হিসেব দেননি। এখন কোরানের বর্ণসংখ্যা নিয়ে কোন দাবিটি (রাশেদ খলিফার হিসেবকৃত বর্ণসংখ্যা ও হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমদের উল্লেখিত সাহাবায়ে কেরামের বর্ণ সংখ্যা) সঠিক? বিচারের ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দেওয়া হল।
আবার হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রচিত বয়ানুল কুরআন-এর সংপ্তি অনুবাদ-এ কোরানের সর্বমোট বর্ণসংখ্যা ৩২১২৫০ উল্লেখ করা হয়েছে। যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়। (দ্রষ্টব্য : ছহীহ্ রহমানী বঙ্গানুবাদ কোরআন শরীফ, পৃষ্ঠা ২১)।
আমাদের জানা মতে রাশেদ খলিফা যদিও কোরানের সর্বমোট শব্দ সংখ্যার মধ্যে কোনো অলৌকিকত্ব দাবি করেননি, কিন্তু প্রাসঙ্গিক বিধায় কোরানের শব্দ সংখ্যা ও বিভিন্ন অর সংখ্যা নিয়ে প্রখ্যাত ইসলামি বুজুর্গদের মতামত তুলে দেওয়া হল :
কোরানের শব্দ সংখ্যা
সাহাবায়ে কেরামরা তাদের যুগে কোরানের শব্দ সংখ্যাও নির্ণয় করেছিলেন। কিন্তু এ সম্পর্কে সরাসরি তাদের সাথে সম্পৃক্ত কোন রেওয়াত পাওয়া যায় না। যা কিছু আছে সবই পরবর্তীকালের। হুমায়দা আযরাজের গণনা অনুযায়ী কোরানের শব্দ সংখ্যা ৭৬,৪৩০, আবদুল আযীয ইবনে আবদুল্লাহর গণনা মোতাবেক ৭০৪৩৯, মোজাহেদের গণনা মোতাবেক ৭৬২৫০, তবে যে সংখ্যাটি সাধারণভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে তা হচ্ছে ৮৬৪৩০। (দ্রষ্টব্য : কোরআন শরীফ: সহজ সরল বাংলা অনুবাদ, পৃষ্ঠা ১১)। এখানের কোনটিই ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়।
বয়ানুল কুরআন-এর সংপ্তি অনুবাদ-এ কোরানের সর্বমোট শব্দসংখ্যা ৮৬,৪৩০ উল্লেখ করা হয়েছে। (দ্রষ্টব্য : ছহীহ্ রহমানী বঙ্গানুবাদ কোরআন শরীফ, পৃষ্ঠা ২১)। যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়।
এ. বি. এম. আব্দুল মান্নান মিয়া ও আহমদ আবুল কালাম বলেন : কুরআনের শব্দ সংখ্যা কত সে বিষয়ে তিনটি মত পাওয়া যায়। যথা-
১. ৭৭৯৩৪ (সাত্তাতর হাজার নয়শত চৌত্রিশটি)
২. ৭৭৪৩৭ (সাত্তাতর হাজার চারশত সাঁইত্রিশটি)
৩. ৭৭২৭৭ (সাত্তাতর হাজার দু’শত সাত্তাতরটি)
কুরআনের হরফ সংখ্যাও এক কথায় নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে শায়খ ইবনুদ দুয়ীস (র)-এর এক বর্ণনায় জানা যায়, কুরআনের সর্বমোট হরফ সংখ্যা হচ্ছে ৩২৩৬৭১ (তিন লক্ষ তেইশ হাজার ছয়শত একাত্তরটি)। (দ্রষ্টব্য : উচ্চ মাধ্যমিক ইসলাম শিক্ষা, দ্বিতীয় পত্র, পৃষ্ঠা ১৯)। উল্লেখিত সংখ্যার কোনোটিই ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়।
কোরানে বিভিন্ন অক্ষরের সংখ্যা
আরবি ভাষার ২৯টি বর্ণ দিয়ে কোরান রচিত। কোরানে উল্লেখিত এই ২৯টি অরের পরিসংখ্যান হাফেজ মুনির উদ্দীনের অনূদিত কোরান থেকে তুলে ধরা হল : আলিফ ৪৮৮৭২, বা ১১৪২৮, তা ১১৯৯, ছা ১২৭৬, জীম ৩২৭৩, হা ৯৭৩, খা ২৪১৬, দাল ৫৬০২, যাল ৪৬৭৭, রা ১১৭৯৩, যা ১৫৯০, সীন ৫৯৯১, শীন ২১১৫, ছোয়াদ ২০১২, দোয়াদ ১৩০৭, তোয়া ১২৭৭, যোয়া ৮৪২, আঈন ৯২২০, গাঈন ২২০৮, ফা ৮৪৯৯, ক্বাফ ৬৮১৩, কাফ ৯৫০০, লাম ২৪৩২, মীম ৩৬৫৩৫, নূন ৪০১৯০, ওয়াও ২৫৫৪৬, হা ১৯০৭০, লাম-আলিফ ৩৭৭০, ইয়া ৪৫৯১৯। (দ্রষ্টব্য : কোরআন শরীফ: সহজ সরল বাংলা অনুবাদ, পৃষ্ঠা ১১)। এখানে উল্লেখিত ২৯টি অক্ষরের মধ্যে কাফ ও লাম-এর সংখ্যা বাদে আর কোনটিই ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়।
হযরত আশরাফ আলী থানভী’র বয়ানুল কুরআন-এর সংক্ষিপ্ত অনুবাদে কোরানের ২৯টি অক্ষরের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তা নীচে তুলে ধরা হল :
আলিফ ৪৮৮৭১, বা ১১৪২৮, তা ১১৯৯, ছা ১২৭৬, জীম ৩২৭২, হা ৯৭৩, খা ২৪১৬, দাল ৫৬৪২, যাল ৪১৯৭, রা ১১৭৯৩, যা ১৫৯০, সীন ৫৮৫১, শীন ৩২৫৩, সোয়াদ ২০১৩, দ্বোয়াদ ১৬০৭, ত্বোয়া ১২৭৪, যোয়া ৮৪২, আইন ১৪১০০, গাইন ২২০৮, ফা ৪৪৯৯, ক্বাফ ৬৮১৩, কাফ ৯৫২৩, লাম ৩৪১২, মীম ২৬৫৩৫, নূন ২৬৫৬০, ওয়াও ২৬৫৩৬, হা ১৯০৭০, লাম-আলিফ ৩৭২০, ইয়া ৩৫৯১৯। (দ্রষ্টব্য : ছহীহ্ রহমানী বঙ্গানুবাদ কোরআন শরীফ, পৃষ্ঠা ২১)। এখানের কোনোটিই ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়।
কোরানে ‘আল্লাহ’ শব্দটির সংখ্যা
দাবি : কোরানে ‘আল্লাহ’ শব্দটি ২৬৯৮ বার উল্লেখিত হয়েছে যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য (১৯×১৪২=২৬৯৮)। এছাড়া ‘আল্লাহ’ উল্লেখ আছে এমন আয়াতগুলোর আয়াত নম্বর যোগ করলে যোগফল হয় ১১৮১২৩, যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য (১৯×৬২১৭=১১৮১২৩)।
আমরা জানি, রাশেদ খলিফা ৯ নম্বর সুরা তওবার শেষের দুটি আয়াত (১২৮ ও ১২৯) ‘মিথ্যা’ দাবি করে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। অথচ সুরা তওবার শেষ আয়াতে ‘আল্লাহ’ শব্দটি রয়েছে। সুতরাং হিসাবটির কি অবস্থা দাঁড়ালো তা সহজেই অনুমেয়।
সুরা আলাক
দাবি : প্রথম নাযিলকৃত সুরা আলাককের আয়াত সংখ্যা ১৯। কোরানের পেছন দিক থেকে গণনা করলে তার ক্রমিক নম্বর হয় ১৯। এছাড়া সুরাটির সর্বমোট আরবি বর্ণসংখ্যা ৩০৪ (১৯×১৬)। সুরাটির প্রথম পাঁচটি আয়াতে বর্ণসংখ্যা ৭৬ (১৯×৪) এবং শব্দ সংখ্যা ১৯টি।
সুরা নাস ও সুরা ফালাক নিয়ে মতানৈক্যের কথা পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে ইসলামি পণ্ডিতদের গ্রন্থ থেকে, সে হিসেবে ৯৬ নম্বর সুরা আলাক কোরানের পেছনের দিক থেকে ১৯ নং সুরা নাও হতে পারে। আবার প্রশ্ন হচ্ছে, কেন পেছনের দিক থেকে গণনা করতে হবে? কেন সামনের দিক থেকে নয়? মিলে যায় বলে? পেছনের দিকটি কি কোনো বিশেষ কারণে আল্লাহর (কিংবা রাশেদ খলিফার) কাছে বেশি প্রিয়? সুরাটির সর্বমোট বর্ণসংখ্যা এবং প্রথম পাঁচটি আয়াতের বর্ণ সংখ্যা ও শব্দ সংখ্যা রাশেদ খলিফা ঠিক কিভাবে-কোন পদ্ধতিতে গণনা করেছেন, তা খুব পরিষ্কার নয়। রহস্যজনক ব্যাপার হচ্ছে সুরাটির সর্বমোট বর্ণসংখ্যা, প্রথম পাঁচটি আয়াতের বর্ণসংখ্যা ও শব্দ সংখ্যাকে ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য দাবি করলেও সবগুলো আয়াতের সর্বমোট শব্দ সংখ্যা ১৯ মিরাকলের বিবেচনায় আনেননি। কারণ এখানে ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্যতার দাবি করা যাচ্ছে না। আবার সুরা আলাকের আয়াত সংখ্যা ১৯টি ধরেছেন; অথচ রাশেদ খলিফার সাধের ‘বিসমিল্লাহ’কে আয়াত হিসেবে ধরলে আয়াত সংখ্যা দাঁড়ায় ২০টি।
সুরা নাসর
দাবি : সুরা নাসর কোরানের সর্বশেষ নাযিলকৃত ওহি। সুরাটির প্রথম আয়াতে ১৯টি বর্ণ রয়েছে।
এ বিষয়ে বেশ কিছু ভিন্নমত রয়েছে, যেমন :
1) সুরা নাসর কোরানের সর্বশেষ ওহি বলে নিশ্চিত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
2) সুরাটি প্রথম আয়াতে আলিফের প্রতিনিধিত্বকারী খাড়া, যবর ও তাশদীদ রয়েছে যা বর্ণ গণনার সময় ‘বিসমিল্লাহ’র মতো একই সমস্যার সৃষ্টি করে।
3) সুরা নাসর যদি সর্বশেষ ওহি হয় তবে নিয়ম অনুযায়ী এই সুরার সর্বশেষ আয়াতটির বর্ণসংখ্যা বিবেচনায় নেওয়ার কথা। এছাড়া রাশেদ সুরাটির সর্বমোট বর্ণসংখ্যাও বিবেচনায় আনতে পারতেন। কিন্তু কেন তা করেননি, তা বুঝতে বুদ্ধিমান পাঠকের কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
4) কোরানের সর্বশেষ সংযুক্ত সুরা ‘সুরা নাস’-এ ধরনের বিভাজ্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না কেন?
হরুফে মুকাত্তাত
রাশেদ খলিফা হরুফে মুকাত্তাত বা কিছু সুরার প্রারম্ভে উল্লেখিত বিচ্ছিন্ন বর্ণগুলোকে নিয়ে পূর্বের মতই অলৌকিকতার জাল বুনেছেন। এক্ষেত্রেও ১৯ সংখ্যা দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্যতার প্রমাণের জন্য রীতিমতো নিজের মনগড়া হিসাবের আশ্রয় নিয়েছেন। অহেতুক লেখাটির কলেবর না বাড়িয়ে উৎসাহী পাঠকদের অনুরোধ করবো রাশেদ খলিফা হরুফে মুকাত্তাতগুলো সম্পর্কিত যে হিসেব দিয়েছেন, তা নিজেরাই একটু যাচাই করে দেখুন, এর অন্তঃসারশূন্যতা সহজেই প্রতীয়মান হয়ে পড়বে। প্রথমেই একটি মজার বিষয় ল্য করবেন রাশেদ খলিফা ২৯টি সুরার প্রারম্ভে হরুফে মুকাত্তাত রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন, অথচ ২৯ সংখ্যাটিই ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়।
হরুফে মুকাত্তাতযুক্ত ২৯টি সুরার বেশিরভাগই মাদানি সুরা, যাকে (হরুফে মুকাত্তাত) সুরার মূল অংশ বলে ধরা হয় না। বলা হয়ে থাকে এগুলো যুক্ত হয়েছে সম্পাদনার সময়। অর্থহীন হরুফে মুকাত্তাতগুলোর মাহাত্ম্য অজানা, অর্থ সম্বন্ধে সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না এবং ‘অতীন্দ্রিয় ও অবাস্তব’ দাবি করে অযথাই রহস্যের জাল তৈরি করা হয়েছে। মুসলিম মনীষীরা হরুফে মুকাত্তাতের ব্যাখ্যা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। ইবনে সিনা, সুয়ুতি, ইবনে খালেদুন, আল-জামাখশারি, আল-বাদাবী প্রমুখ জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিত্বরা এ ব্যাপারে তাঁদের মূল্যবান অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আল্লামা সুয়ুতি বলেন : আল-কোরানের ১৯ নম্বর সুরা মরিয়মের প্রারম্ভে ব্যবহৃত ‘কাফ্-হা-ইয়া-আইন-সা’দ’ অক্ষরগুলো আল্লাহর পাঁচটি গুণাবলীকে প্রকাশ করছে; যেমন কাফ্ (ک) অক্ষরটি করিম (সদয়), হা (ﮪ) অক্ষরটি হাদী (পথপ্রদর্শক), ইয়া (ﻯ) অক্ষরটি হাকিম (বিজ্ঞ), আইন (ع) অক্ষরটি আলিম (জ্ঞানী), এবং সোয়াদ (ص) অক্ষরটি সাদিক (ন্যায়নিষ্ঠ) বোঝাচ্ছে। তদ্রুপ ৭ নম্বর সুরা আল-আ’রাফ-এর প্রারম্ভে ব্যবহৃত ‘আলিফ-লাম-মীম-সোয়াদ’ দ্বারা বোঝায় ‘আনাল্লাহু রাহমানুস্ সামাদ’ (আমি আল্লাহ, দয়ালু ও চিরঞ্জীব)। আল-বাদাবী একই ধরনের মত পোষণ করে বলেন : “১৩ নম্বর সুরা আর রা’দ-এর প্রারম্ভে ব্যবহৃত ‘আলিফ-লাম-মীম-রা’ অর দ্বারা ‘আনাল্লাহু আলিমু ওয়ারা’ (আমি আল্লাহ সবজান্তা, সর্বদ্রষ্টা) বুঝিয়েছে। পাশাপাশি ইউরোপিয় কোরান-বিশ্লেষক যেমন এলয়স স্প্র্রেঙ্গার, থিওডোর নলডেক, হার্সফিল্ড, ওটো লথ, হ্যান্স বুয়ের প্রমুখ ব্যক্তিরাও কোরানের হরুফে মুকাত্তাত সম্পর্কে বক্তব্য প্রদান করেছেন। ইউরোপিয় কোরান-বিশ্লেষকদের মধ্যে হার্সফিল্ড (Hartwig Hirschfeld) হরুফে মুকাত্তাত সম্পর্কে বলেন[32]: “সোয়াদ (ص) অক্ষরটি নবী মুহাম্মদ পত্নী হাফসার জন্য, নূন (ن) অক্ষরটি হজরত ওসমানের জন্য, মীম (م) অরটি আল মুগিরা, ত্বোয়া (ط) অক্ষরটি (হজরত আয়েশার ছোট বোনের স্বামী) তালহা ইত্যাদি। এরা সকলেই নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন কোরান সংকলনের সাথে।” অর্থাৎ হার্সফিল্ডের মতানুসারে কোরান সংকলনের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা কোরানের বিভিন্ন সুরার প্রথমে নিজেদের নামকে সাংকেতিক চিহ্নরূপে ঢুকিয়ে দিয়েছেন৷ (দ্রষ্টব্য : Foundations of Islam: The Making of a World Faith, page 155-156)৷
আমরা রাশেদ খলিফার ‘১৯ মিরাকল’-এর কয়েকটি মূল দাবি সম্পর্কে জানতে পারলাম। এ ধরনের আরও বেশ কিছু দাবি তিনি উত্থাপন করেছেন যা শুধুই তাঁর কৌশলী ধূর্ততা উন্মোচন করে। রাশেদ খলিফার এ ধরনের দাবি সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলা প্রয়োজন।
১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়
রাশেদ খলিফা কোরানের সাথে সম্পর্কিত যেসব সংখ্যা কৌশলে ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য বলে চালিয়ে দেওয়া যায় সেগুলোকেই শুধু বিবেচনায় এনেছেন। কিন্তু কোরানের সাথে সম্পর্কিত এমন অনেক কিছু আছে যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয় অথচ হতে পারতো। নীচে এরকম কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হলো :
1) কোরানের রুকু সংখ্যা ৫৪০টি, ৩০টি পারা, ৭টি মঞ্জিল রয়েছে, যার কোনোটিই ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়।
2) কোরানের প্রতিটি সুরার আয়াত (যথা সুরা বাকারার আয়াত সংখ্যা ২৮৬, সুরা আল-ই-ইমরানের আয়াত সংখ্যা ২০০ ইত্যাদি), শব্দ ও বর্ণ সংখ্যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য হতে পারত।
3) বলা হয় কোরান ২৩ বছর ধরে অবতীর্ণ হয়েছে। ২৩ সংখ্যাটি ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়।
4) হজরত মুহাম্মদ ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেন। এই ৪০ সংখ্যাটি ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়।
5) কোরানের প্রতিটি আয়াতের শব্দ ও বর্ণ সংখ্যা ১৯ দিয়ে বিভাজ্য হতে পারত।
6) কোরানের যে আয়াতে ১৯ ম্যাজিকের কথা বলা হচ্ছে, তা হল ৭৪ নম্বর সুরা মুদ্দাচ্ছিরের ৩০ নম্বর আয়াত। এই ৭৪ এবং ৩০ সংখ্যাদ্বয় ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়।
7) কোরানের প্রতিটি বর্ণের আলাদা আলাদা সুনির্দিষ্ট সংখ্যা থাকতে পারত, যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য।
8) কোরানের সুনির্দিষ্ট সুরা সংখ্যা, আয়াত সংখ্যা, শব্দ-বর্ণ সংখ্যা থাকতে পারত, যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য।
এরকম প্রচুর উদাহরণ রয়েছে যা কোরান বা ইসলামের সাথে সম্পর্কিত সংখ্যা হওয়া সত্ত্বেও ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়।[33] ১৯ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্যতা যদি কোরানের অলৌকিকতার প্রমাণ হতে পারে তবে ১৯ দ্বারা অবিভাজ্যতা লৌকিকতার প্রমাণ হবে না কেন?
নিঃশেষে বিভাজ্যতা
আমাদের প্রয়োজনের কারণেই কখনো কখনো নিঃশেষে বিভাজ্যতাকে আমরা অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকি; ধরা যাক, আমাদের কাছে ১০টি আম আছে এবং আমরা সংখ্যায় মোট পাঁচ জন। তাহলে সহজেই আমাদের সবার মধ্যে সমান ভাগে আম ভাগ করে দেওয়া সম্ভব৷ কিন্তু আম যদি ১১টি হয়, তবে আমাদের পাঁচ জনের কাছে সমান ভাগে ভাগ করে দেওয়া কিছুটা জটিল হয়ে পড়বে৷ অর্থাৎ নিঃশেষে বিভাজ্যতার কারণে যে সুবিধা পেয়ে থাকি প্রয়োজন পূরণের জন্য তা আমাদের দুর্বলতার কারণে৷ অনেক ক্ষেত্রে আবার নিঃশেষে বিভাজ্যতার কোনো প্রয়োজন হয় না, যেমন পানীয়ের ক্ষেত্রে৷ পানীয়কে আমরা ইচ্ছেমত সমানভাগে ভাগ করতে পারি৷ আরেকটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, ক্রমিক যে কোনো ১৯টি সংখ্যার মধ্যে একটি সংখ্যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য হবে৷ তাই নিঃশেষে বিভাজ্যতার সাথে অলৌকিকতার যে কোনো সম্পর্ক নেই তা বুঝতে গভীর চিন্তার প্রয়োজন নেই।
আবার নিঃশেষে বিভাজ্যতাকে যদি কেউ অলৌকিক বলে দাবি করেন তবে অবিভাজ্যতাকে কেন অলৌকিক বলা যাবে না? যেমন কেউ বললো, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের (অধ্যায় সংখ্যা, পৃষ্ঠা সংখ্যা, বাক্য সংখ্যা, বর্ণ সংখ্যা ইত্যাদি) কোনো কিছুই ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়, তাই গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ একটি ‘অলৌকিক কাব্যগ্রন্থ’। তখন অলৌকিক-অন্বেষণকারীরা কি জবাব দিবেন?
কেন ১৯?
কোরানে ৭ আসমানের কথা আছে, ৬ দিনে বিশ্ব সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে ইত্যাদি কিন্তু রাশেদ খলিফা কোরানে এত সংখ্যা থাকতে কেন ১৯ সংখ্যাটিকে বেছে নিলেন তার একটি জবাব তিনি নিজেই দিয়েছেন, যদিও তা মোটেও সন্তুষজনক নয়। যেসব কারণ তিনি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন, তার বেশ কতকগুলো পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। রাশেদ খলিফা প্রদত্ত আরো কয়েকটি কারণ নিয়ে আলোচনা করা যাক[34]:
১। ১৯ একটি মৌলিক সংখ্যা।
> তাতে কি? মৌলিক সংখ্যা তো প্রচুর আছে, যেমন ৩, ৫, ৭, ১১, ১৩, ২৩ ... ইত্যাদি। আর কোরানেও তো ১৯ ছাড়া আরো কয়েকটি মৌলিক সংখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়, যেমন ৭।
২। ১ ও ৯ অঙ্কদ্বয় পৃথিবীর সব ভাষায় একই রকম। অর্থাৎ ১ ও ৯-এর লিখিতরূপ পৃথিবীর সব ভাষায় একই।
> অলৌকিকতা অন্বেষণের এ ধরনের উছিলা একমাত্র মূর্খতা আর নির্বুদ্ধিতার মহামিলনের ফলেই সম্ভব।
৩। ১০ + ৯ = ১৯
১০২ – ৯২ = ১৯
> এটি যে কোনো পর্যায়ক্রমিক দুটি সংখ্যার জন্য প্রযোজ্য। যেমন :
৩ + ২ = ৫
৩২ - ২২ = ৫
৫ + ৪ = ৯
৫২ - ৪২ = ৯
১৩ + ১২ = ২৫
১৩২ - ১২২ = ২৫
এটিকে কারণ হিসেবে ধরলে, রাশেদ খলিফার ভণ্ডামীটা আরও প্রকট হয়ে ওঠে।
৪। আমরা যেসব অঙ্ক গাণিতিক কাজে ব্যবহার করি, তার প্রথম সংখ্যা ১ এবং শেষটি ৯।
> গাণিতিক হিসাব-নিকাশ আমরা সাধারণত দশমিক পদ্ধতি বা দশভিত্তিক পদ্ধতি ব্যবহার করি। মানব ইতিহাসে সংখ্যার ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকে দশভিত্তিক সংখ্যা গণনা সুবিধাজনক হওয়ায় (কেউ কেউ বলেন আমাদের হাতে দশটি আঙুল থাকায়) এই পদ্ধতি দীর্ঘদিন অনুসরণ করে আসছি; যেমন আমরা গণনার সময় ৯ এর পরই ১০ চলে যাই কিন্তু এর মধ্যে আরো কিছু সংখ্যা থাকতে পারতো অথবা কিছু সংখ্যা কম হতে পারতো। তাই দশমিক পদ্ধতির গণনায় (০ বাদ দেওয়ায়) প্রথম সংখ্যা ১ এবং শেষ সংখ্যা ৯ হওয়ার সুবাদে এখানে কি অলৌকিকত্ব পাওয়া গেল তা বোধগম্য নয়?
বর্তমানে শুধু দশমিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তাও নয়। বিভিন্ন প্রয়োজনে আরো কিছু সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেমন :
বাইনারি পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে সংখ্যা হচ্ছে দুটি ০ ও ১। কম্পিউটারের যাবতীয় সব প্রোগাম এই বাইনারি মেথডে লেখা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতি ১৯ লেখা হয় ১০০১১।
অকটেট পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে যেসব অঙ্ক ব্যবহৃত হয়ে থাকে তার প্রথমটি ০ ও শেষটি ৭। আর এ পদ্ধতিতে ১৯ লেখা হয় ২৩।
হেক্সাডেসিমেল পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে যেসব অঙ্ক ব্যবহৃত হয় তার প্রথমটি ০ ও শেষটি F। এ পদ্ধতিতে ১৯কে লেখা হয় ১৩।
তাই শুধুমাত্র ডেসিমেল বা দশমিক পদ্ধতিকে বিবেচনায় এনে ১৯-এর মধ্যে অলৌকিকত্ব খোঁজাকে অজ্ঞতার পরিচায়ক বলে ধরে নিতে হবে।
১৯ একটি ছোট সংখ্যা ভালো করে খোঁজলে ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য অনেক কিছুরই (যেমন কারো জন্ম সাল, মৃত্যু সাল, জীবনের স্মরণীয় ঘটনার তারিখ, মাসিক আয়-ব্যয়, কিংবা কোনো বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা, অধ্যায় সংখ্যা, শব্দ ইত্যাদি) সংখ্যা পাওয়া যাবে। শুধু ১৯ কেন, এরকম যে কোনো ছোট সংখ্যা দ্বারা একই ধরনের অলৌকিকতার দাবি উত্থাপন করা সম্ভব।
সম্ভাবনা ও অলৌকিকতা
রাশেদ খলিফা কোরানের সাথে সম্পর্কিত কিছু সংখ্যা ১৯ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য বলে দাবি করে একেই কোরানের অলৌকিকতার পে প্রমাণ বলে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়। ‘১৯ মিরাকল’ বিষয়টি যদি সত্যি সত্যি ধর্মগ্রন্থ ব্যতীত অন্য কোনো গ্রন্থ যেমন গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ ইত্যাদি যে কোনোটির বেলায় ঘটত তবে কেউ কি ঐ গ্রন্থকে অলৌকিক বলে মেনে নেবেন? যদিও অনেক গ্রন্থে এই ধরনে ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে তবে কেউ তা গণনা করার চেষ্টা করবেন না; কারণ এর মধ্যে অলৌকিকতা (মূলত সংখ্যা তত্ত্বের চমৎকার ব্যবহার) খুঁজে বের করলেও তা বাজারে চলবে না, ধর্মব্যবসাও হবে না।
সম্ভাবনা বিষয়ে একটি কথা বলা প্রয়োজন। একজন লেখকের লেখা কোনো একটি গ্রন্থ (নকল করা ছাড়া) হুবুহু আরেকজন লেখকের পক্ষে কাকতালীয়ভাবে লিখে ফেলা একদম অসম্ভব। শরৎ চন্দ্রের ‘পথের দাবী’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে-বাইরে’ বাংলা ভাষায় আর কেউ লিখবেন না, এটাই স্বাভাবিক এবং এর অন্যথা অসম্ভব। এ জন্য এই গ্রন্থগুলি অলৌকিক হয়ে যায়নি। অর্থাৎ আমরা বলতে চাচ্ছি, কোনো কিছুর অসম্ভাব্যতা এর অলৌকিকতার প্রমাণ হতে পারে না।
রাশেদ খলিফার দাবি যদি সত্যি হত
রাশেদ খলিফার দাবি মতো যদি কোরান সত্যিই ১৯ সংখ্যা দ্বারা আবদ্ধ থাকতো তবে এ সম্পর্কে দুটি কথা বলার অবকাশ থাকতো :
১। এটি সম্পূর্ণ কাকতালীয় (Coincidence)। এ রকম অনেক ঘটনা বাস্তবে ঘটে থাকে, যেমন ফিবোনাক্কি রাশিমালা। এ ধরনের ঘটনা যদি ধর্মগ্রন্থ ব্যতীত অন্য কোন গ্রন্থ বা অন্য বিষয়ে পাওয়া যায় তবে তা অলৌকিক বলে দাবি করা হয় না। তাছাড়া মৌলিক যে প্রশ্নটি উত্থাপিত করা যায় : কোনো গ্রন্থের বা কোনো বিষয়ের রচনাশৈলী (Style) কি ঐ বিষয়বস্তুর বৈধতা দিতে পারে? স্টাইল হচ্ছে কেমন করে-কিভাবে একটি বিষয়কে উপস্থাপন করা হবে, আর বিষয়বস্তু হচ্ছে কী উপস্থাপন করা হবে। উত্তরটা হচ্ছে না, স্টাইল বিষয়বস্তুর বৈধতা বা Validity দিতে পারে না; কারণ একই বিষয় ভিন্ন ভিন্ন স্টাইলে উপস্থাপন করা সম্ভব আর ভিন্ন ভিন্ন বিষয়বস্তু একই স্টাইলে বা রচনাশৈলী দ্বারা উপস্থাপন করা সম্ভব। স্টাইল ও বিষয়বস্তুর মধ্যে আন্তসম্পর্ক নেই। স্টাইল বা রচনাশৈলী বলতে বুঝি : কোন ভাষায় এটি উপস্থাপন করা হচ্ছে, গদ্যে না পদ্যে, এটি মৌখিক না লিখিত, হস্তলিখিত না প্রিন্ট করা, লেখার অর কত বড়, বাক্য কত বড়, অরের সংখ্যা কতটি, শব্দ-প্যারাগ্রাফ-লাইন কতটি, বিষয়টি কি শ্রুতিমধুর, সুন্দর, শব্দগুলো-বাক্যগুলোর মধ্যে অন্তমিল কিরকম, বাচনভঙ্গি কিরকম ইত্যাদি।[35] রচনাশৈলী ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে এ কথা বলার কারণ হচ্ছে, কোরানসহ যে কোনো ধর্মগ্রন্থকেই তার রচনাশৈলী দ্বারা অলৌকিক দাবি করার মধ্যে কোনো যৌক্তিকতা নেই।
২। এটি পূর্বপরিকল্পিত; যেমন আমেরিকান লেখক Ernest Vincent Wright-এর লেখা Gadsby: Champion of Youth উপন্যাসটি বা ইভান পেনিনের আবিষ্কার ওল্ডটেস্টামেন্টের অলৌকিক ৭ সংখ্যা। যেহেতু বাইবেলে বলা হয়েছে অনেক লেখক এই গ্রন্থ রচনা করেছেন, তাই পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ৭ সংখ্যাটি সময়ে সময়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোরান সম্পর্কে যুক্তিবাদীরা বলেন : “হজরত মুহাম্মদ উম্মি বা নিরক্ষর ছিলেন না। বোখারির প্রচুর সহি হাদিস রয়েছে যা নবী মুহাম্মদকে লেখাপড়া জানা মানুষ হিসেবেই উপস্থাপন করে; যেমন সহি বোখারি শরিফ, ভলিউম ৭, বুক ৬২, নম্বর ৮৮; সহি বোখারি শরিফ, ভলিউম ১, বুক ৩, নম্বর ৬৫; সহি বোখারি শরিফ, ভলিউম ১, বুক ৩, নম্বর ১১৪। ঐ সময়ে (ষষ্ঠ শতাব্দী) আরবের কাব্য-সাহিত্যের স্বর্ণযুগ চলছিল। মুহাম্মদ তাঁর সাথীদের নিয়ে কোরান রচনা করেছেন যা কোনো কঠিন কাজ নয়। কোরানকে অতুলনীয় গ্রন্থ বলা যায় না; বিষয়বস্তুর দিক দিয়েও শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ নয়। যদিও তাতে (কোরানে) প্রায়শই জোরপূর্বক অলৌকিকতা আরোপের প্রচেষ্টা চালানো হয়।বর্ণসংখ্যা ও বাক্যসংখ্যার সুনির্দিষ্ট সংখ্যার ভিত্তিতে অগণিত সাহিত্য রচিত হয়েছে।উদাহরণস্বরূপ ‘চতুর্দশপদী কবিতা’ (সনেট)।” অর্থাৎ হজরত মুহাম্মদ এবং তাঁর সহযোগীরা ১৯ সংখ্যার বিষয়টি মাথায় রেখেই কোরান রচনা করেছিলেন।
কোরান সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্যের জবাব রাশেদ খলিফার ‘১৯ মিরাকল’ থেকে দেওয়া যায় না। কোরানকে অলৌকিক প্রমাণের রাশেদ খলিফার সংখ্যাভিত্তিক কৌশল সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
উপসংহার
দীর্ঘ আলোচনার পর আমরা দেখলাম :
1) উনিশ নিয়ে কোরানের অলৌকিকত্ব প্রমাণের রাশেদ খলিফার দাবি অন্তঃসারশূন্য।
2) কোরানের সুরা আল-মুদাচ্ছির (৭৪) এর ৩০ নম্বর আয়াতে শুধুমাত্র দোজখের ফেরেশতাদের সংখ্যা বলা হয়েছে; কোনো অলৌকিক সংখ্যা (যেমনটা রাশেদ খলিফা দাবি করেছেন) বা অন্য কিছু বলা হয়নি।
3) রাশেদ খলিফা কোরান শরিফে ‘অলৌকিকত্বের উপস্থিতি’ প্রমাণের জন্য কোরানের আয়াতে যেমন পরিবর্তন করেছেন, তেমনি আয়াত কেটে কমিয়ে দিয়েছেন, ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
4) এই ধরনের কথিত ‘মিরাকল’ ধর্মগ্রন্থ কোরান ছাড়াও আরো অন্যান্য গ্রন্থে রয়েছে।
5) (ইসলামি ভাষ্য মতেই) সম্পূর্ণ কোরান যেহেতু লিখিতরূপে নাযিল হয়নি, তাই এর লিখিতরূপের মধ্যে অলৌকিকতা খোঁজে পাওয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অপ্রাসঙ্গিকও বটে। একটি ভাষার লিখিতরূপ ভাষা বিশেষজ্ঞরা সময়ে-সময়ে গণমানুষের প্রয়োজনে নির্ধারণ করে থাকেন। পরিবর্তন-পরিবর্ধন-সংযোজন-বিয়োজন ঘটান। অর্থাৎ ভাষার লিখিতরূপ সম্পূর্ণ লৌকিক।
‘মিরাকল’ টাইটেল জুড়ে দিয়ে কোটি মানুষের দুর্বল আবেগ-অনুভূতির কেন্দ্র ‘ধর্মগ্রন্থ’ নিয়ে কত অসাধু ব্যবসা করা যায় তারই সামান্য উদাহরণ রাশেদ খলিফার এই ‘১৯ মিরাকল’।যুগে যুগে ধর্ম আর ধর্মগ্রন্থকে কেন্দ্র করে ধর্মব্যবসায়ী-প্রতারকচক্র এ ধরনের হুজুগ সৃষ্টি করে এসেছেন নিজেদের কায়েমী স্বার্থ রার তাগিদ থেকে।এতে বিস্ময়ের কিছু নেই।কিন্তু অবাক লাগে যখন উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ সনদপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা পর্যন্ত নিজেদের এতোদিনের অর্জিত কাণ্ডজ্ঞান-যুক্তিবোধ-শিক্ষাদীক্ষা সব কিছু রহিত করে গা ভাসিয়ে দেন হুজুগের তালে।
——————————————–
লেখক পরিচিতি : সৈকত চৌধুরী, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল-এর সাথে যুক্ত।অনন্ত বিজয় দাশ, শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।সাধারণ সম্পাদক, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল।সম্পাদনা : বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার ছোটকাগজ ‘যুক্তি’।
তথ্যসূত্র:
১ Hume, David. An Inquiry Concerning Human Understanding, Section X "Of Miracles," (1748), Bobbs-Merrill, Library of Liberal Arts edition. http://18th.eserver.org/hume-enquiry.html#10
২ http://www.newstatesman.com/Life/200606050009
৩ আরো দেখুন : Ali Sina, The Miracles of Allah, http://www.faithfreedom.org/Articles/sina/miracles_of_allah.htm
৪ The Skeptic's Dictionary, pareidolia, http://www.skepdic.com/pareidol.html
৫ http://www.dailymail.co.uk/pages/live/articles/news/worldnews.html?in_article_id=487764&in_page_id=1811
৬ আগ্রহীরা এই ওয়েব সাইট থেকে পুরো উপন্যাস পাঠ করতে পারবেন : http://www.spinelessbooks.com/gadsby/index.html
৭ অনন্ত বিজয়, ‘ফিবোনাক্কির গণিত রহস্য’, সাপ্তাহিক দিবালোক, ঈদসংখ্যা, ৮ ডিসেম্বর(রোববার), ২০০৮, বিয়ানী বাজার, সিলেট, পৃষ্ঠা ৩।
৮ প্রবীর ঘোষ, অলৌকিক নয় লৌকিক, প্রথম খণ্ড, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, প্রকাশ জানুয়ারী ১৯৯০, পৃষ্ঠা ১৭৬-১৯১।
৯ Uri geller, The 11:11 phenomenon, http://www.uri-geller.com/articles/11.htm
১০ The Skeptic's Dictionary, law of truly large numbers (coincidence), http://skepdic.com/lawofnumbers.html
১১ Keith Newman, Is God A Mathematician?, http://www.wordworx.co.nz/panin.html
১২ G. Nehls, The Mysterious 19 in the Quran: A Critical Evaluation, http://www.answering-islam.org/Nehls/Ask/number19.html
১৩ http://www.greaterthings.com/Word-Number/CenterofBible/Psalm118.htm
[14] Submission.org, Tampering With the Word of God, Appendix 24, http://www.submission.org/tampering.html. And Preserving and protecting the Quran, http://www.submission.org/quran/protect.html.
[15] কাজী জাহান মিয়া, আল-কোরআন দ্য চ্যালেঞ্জ (মহাকাশ পর্ব-১), প্রকাশক: নাহরীন পারভীন, রায়ের বাজার, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ অক্টোবর, ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৭-২৯।
[16] ডা. খন্দকার আব্দুল মান্নান, কম্পিউটার ও আল কুরআন, প্রকাশনায়: ইশায়াতে ইসলাম কুতুবখানা, মীরপুর, ঢাকা, পঞ্চম মুদ্রণ: সেপ্টেম্বর ২০০৩।
[17] হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমদ, কোরআন শরীফ: সহজ সরল বাংলা অনুবাদ, আল কোরআন একাডেমী লন্ডন, প্রথম প্রকাশ মার্চ ২০০২।
[18] হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ:) (মূল উর্দু), ছহীহ রহমানী বঙ্গানুবাদ কোরআন শরীফ (বয়ানুল কোরআনের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ), হামিদিয়া লাইব্রেরী লি:, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৯৪২।
[19] এ, কে, এম, ফজলুর রহমান মুন্সী, বঙ্গানুবাদ কোরান শরীফ, প্রকাশক: এ, কে, এম, শহিদুল হক, কুমিল্লা, অনুবাদ কাল ১৯৬২-৬৫, পৃষ্ঠা ৪৮০।
[20] মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহ:), তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন, পবিত্র কোরআনুল করীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর) অনুবাদ ও সম্পাদনা : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, খাদেমুল-হারমাইন বাদশাহ ফাহদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প, পৃষ্ঠা ১৪১৯, ১৪২১।
[21] অধ্যক্ষ নাসিম উদ্দিন আহমদ, পবিত্র কোরআন (পাদটীকাসহ বাংলা ও ইংরেজীতে অনুবাদ), রংপুর পাবলিকেশন্স লি: ঢাকা, প্রকাশকাল : জানুয়ারি ২০০০, পৃষ্ঠা ১৩০০।
[22] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, তাফহীমুল কুরআন (অনুবাদ: মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম), ১৮শ খণ্ড, খায়রুন প্রকাশনী, ঢাকা, প্রকাশকাল: জুলাই ২০০৬, পৃষ্ঠা ১০৭, ১০৯।
[23] আল-কুরআনুল করীম, অনুবাদ: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, প্রকাশকাল: অক্টোবর, ১৯৯৪ (অষ্টম মুদ্রণ), পৃষ্ঠা ৯৬৮।
[24] সাইয়েদ কুতুব শহীদ, তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন, অনুবাদ: হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমদ, ২১তম খণ্ড, আল কোরআন একাডেমী লন্ডন, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০৩ (৪র্থ সংস্করণ), পৃষ্ঠা ২৩৩-২৩৪।
[25] সা’দ উল্লাহ, ইসলামী দর্শন ও দার্শনিক, সময় প্র্রকাশন, ঢাকা, প্র্রকাশ ২০০০, পৃষ্ঠা ১৯৪।
[26] http://www.submission.org/false-verses.html
[27] http://www.usc.edu/schools/college/crcc/engagement/resources/texts/muslim/quran/
[28] http://www.submission.org/suras/sura9.html
[29] এ. বি. এম. আব্দুল মান্নান মিয়া ও আহমদ আবুল কালাম, উচ্চমাধ্যমিক ইসলাম শিক্ষা, দ্বিতীয় পত্র, হাসান বুক হাউস, ঢাকা, চতুথ সংস্করণ, ২০০৫, পৃষ্ঠা ১৮-১৯।
[30] Benjamin Walker, Foundations of Islam: The Making of a World Faith, Rupa & Co, New Delhi, 2004, Page 158-159.
[31] William Campbell, A Numeric Miracle of the Number 19?, http://answering-islam.org.uk/Campbell/s6c1.html
[32] Aurthur Jeffery, The Mystic Letters of the Koran, http://www.answering-islam.org/Books/Jeffery/mystic_letters.htm.
[33] Mumin Salih, New Amazing Numerical Findings in the Quran, http://www.news.faithfreedom.org/index.php?name=News&file=article&sid=1836.
[34] http://www.submission.org/quran/app1-part2.html
[35] Hekmat, The Miracle of 19, http://www.faithfreedom.org/Articles/Hikmat10101.htm
লেখাটি পিডিএফ আকারে পড়তে চাইলে দেখুন এখানে
۞۞۞۞۞۞۞۞۞۞
প্রবন্ধটি কিছুটা পরিবর্তিত এবং পরিবর্ধিত আকারে যুক্তি (সংখ্যা ৩, জানুয়ারি ২০১০) পত্রিকায় প্রকাশিত