একাত্তরে ধর্ষণের ইতিহাস বিকৃতিঃ একটি পুনর্মিত্রতার ব্যবস্থাপত্র?

মূলঃ নয়নিকা মূখার্জী
অনুবাদ : তানভীর ইসলাম

(আলোচ্য রচনাটি শর্মিলা বোসের বিতর্কিত নিবন্ধঃ "Anatomy of Violence: Analysis of Civil War in East Pakistan in 1971" (EPW, Oct 8, 2005) একটি পর্যালোচনা। বোসের নিবন্ধটির প্রথম সংস্করণ ডঃ বোস ২০০৫ সালের ২৮-২৯ জুন যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতরের ইতিহাস বিভাগ আয়োজিত দুই দিন ব্যাপী এক সম্মেলনে উপস্থাপন করেন। সম্মেলনের শিরোনাম ছিল “ সংকটে দক্ষিণ এশিয়াঃ যুক্তরাষ্ট্রের নীতি, ১৯৬১-১৯৭২”। এ সময় তকালীন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দলিলপত্রসমূহ জনসমক্ষে প্রকাশ উপলক্ষে এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়)

একজন ভারতীয় হিসেবে বাংলাদেশে প্রায় এক দশক ১৯৭১ সালের যুদ্ধে যৌন নিপীড়ন বিষয়ে সাধারণ মানুষের স্মৃতিচারণ নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতায় শর্মিলা বোসের নিবন্ধে বাংলাদেশের যুদ্ধকে ‘গৃহযুদ্ধ’ হিসেবে উল্লেখ করায় আমি বিশেষভাবে আহত হয়েছি। অধিকাংশ বাংলাদেশীই বাংলাদেশের যুদ্ধকে ‘গৃহযুদ্ধ’ হিসেবে উল্লেখ করতে অস্বীকার করেন, যেহেতু এতে এর সাথে সংশ্লিষ্ট গণহত্যাকেও অস্বীকার করা হয়। পরিবর্তে তারা বাংলাদেশের যুদ্ধকে অর্থগত এবং রাজনৈতিকগতভাবে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বা ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’ হিসেবে আলাদা চোখে দেখেন।

এর সাথে এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন, ঠান্ডা যুদ্ধ সময়কার রাজনীতিতে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে এবং ভারত সরকার পূর্ব পাকিস্তানের গেরিলা যোদ্ধাদের সাহায্য করেছিল, তখন বাংলাদেশের যুদ্ধে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল তাকে আজ পর্যন্ত স্বীকার করা হয় নি। শর্মিলা বোসের নিবন্ধটির শিরোনামে ‘গৃহযুদ্ধ’ শব্দের ব্যবহার তাই ১৯৭১-এর ঘটনাবলী সম্পর্কে পাক-মার্কিন সরকারের যে সংস্করণ প্রচলিত রয়েছে- তার প্রতিই সমর্থন ব্যক্ত করে। অথচ নিবন্ধটির দাবী এটি একটি ‘নিরপেক্ষ বিবরণ’। আমার কাছে এটি ধোঁকা মনে হয়েছিল।

বোস যেগুলোকে ‘কেস স্টাডি’ বলছেন তার সবগুলোতে তিনি মূলত এটাই হাইলাইট করতে চেয়েছেন- ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিবাহিনী উভয়েই নিপীড়নে যুক্ত ছিল। বাংলাদেশের যুদ্ধ সময়কালীন তার ‘কেস’গুলোতে তিনি কোন ধর্ষণের ঘটনা খুঁজে পাননি- এমন কথাও তার দীর্ঘ নিবন্ধের শেষে ক্ষুদ্র একটি প্যারাগ্রাফে উল্লেখ করেছেন। নিপীড়নে সব পক্ষই যুক্ত ছিল এধরণের একটি স্বীকার্যের মাধ্যমে তিনি সব পক্ষের মধ্যে পুনর্মিত্রতারও একটি পন্থা বাতলে দিয়েছেন।

ওয়াশিংটনের এক কনফারেন্সে শর্মিলা বোসের এ নিবন্ধটি উত্থাপিত হবার অব্যবহিত পর পাকিস্তানী পত্রপত্রিকাগুলোয় ত্বরিত এ বিষয়ে লেখা ছাপা হয়- দ্য ডেইলি টাইমস (হাসান, জুন ৩০, ২০০৫; সম্পাদকীয় জুলাই ২, ২০০৫) এবং ডন (ইকবাল, জুলাই ৭, ২০০৫)। দু’টো পত্রিকাই বোসের বরাত দিয়ে উল্লেখ করে- বাংলাদেশের যুদ্ধে সব পক্ষ দ্বারাই নিপীড়ন হয়েছে এবং কোন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে নি। জনপ্রিয় ইন্টারনেট বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ায় শর্মিলা বোসের ওপর নিবন্ধেও যুদ্ধে ধর্ষণ সম্পর্কে শুধু সেই ছোট প্যারাগ্রাফটিকেই পুনরুল্লেখ করা হয়।

২০০৫ সালের ২ রা জুলাই ওয়েব মেইলভিত্তিক বাংলাদেশী গ্রুপ ‘উত্তরসূরী’র এক প্রশ্নের জবাবে বোস বলেন-“পাকিস্তানের ডেইলি টাইমস তাদের রিপোর্টে যে শিরোনাম দিয়েছে তা সঠিক নয় এবং এটি তার গবেষণার ভিত্তিতে পাওয়া তথ্য থেকে হয় নি”। শর্মিলা বোসের গবেষণা বাংলাদেশে সমালোচনার ঝড় তোলে এবং তার গবেষণা পদ্ধতি নিম্নমানের এবং পক্ষপাতদুষ্ট- এ অভিযোগগুলো উত্থাপিত হয়। কলিংউড (১৯৪৫) দেখিয়েছেন- ইতিহাস হচ্ছে আসলে ইতিহাসবিদের মননে অতীতকে পুনর্নিমাণ, যেখানে অতীত নিয়ে প্রত্যেকের নিজস্ব বাছাই ও ব্যাখা থাকে- কারণ ইতিহাস হল আসলে একটি নির্দিষ্ট বর্ণনাশৈলী বেছে নেয়া এবং সেটাও ঐতিহাসিকভাবেই নির্ধারণ করতে হয়।

ইকোনমিক এবং পলিটিক্যাল উইকলিতে (EPW) –তে বোসের নিবন্ধ প্রকাশের প্রায় দশ মাস পর আমার এ আলোচনা বোসের গবেষণা বিষয়ে বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া, বোসের জবাব এবং গবেষণায় বোসের বর্ণনাশৈলীকে তুলে ধরার একটি প্রচেষ্টা যা অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিভিন্ন তথ্যের মাধ্যমে কোন বিশেষ উদ্দেশ্যসাধনে ব্যবহৃত হয়েছে।

এ আলোচনায় আমি মূলত বোসের বিবরণের তিনটি বিষয় পর্যালোচনা করব- ক) যুদ্ধে উভয় পক্ষ দ্বারা নির্যাতন করা হয়েছিল খ) তার ‘কেস’গুলোতে ধর্ষণের কোন ঘটনা না পাওয়া এবং গ) তার মীমাংসার প্রস্তাবনা যাচাই করা এবং উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে এর প্রভাব বিশ্লেষণ।

ক) উভয় পক্ষ দ্বারা নিপীড়ন

বোসের নিবন্ধে সব পক্ষের সম্পৃক্ত থাকা দেখানো হয়েছে এভাবে যে এরা সবাই “যুদ্ধে প্রচলিত রীতির বাইরে পাশবিক কাজকর্ম করেছিল এবং মানবিকতাও দেখিয়েছিল...বিশৃংখলার মধ্যে বাঙালী, বিহারী এবং পশ্চিম পাকিস্তানীরা একে অন্যকে সাহায্য করেছিল”। প্রমাণ হিসেবে দেখানো হয়েছে- পাকিস্তানী সৈন্যরা নারী ও শিশুদের বাদ দিয়ে শুধু পূর্ণবয়স্ক পুরুষদেরই টার্গেট করেছিল। পাকিস্তানী সৈন্যরা নয়; বরং স্থানীয় বাঙালী বিশ্বস্ত/সহযোগীরাই (রাজাকার) তাদের স্বজাতি বাঙালীদের ওপর অত্যাচার এবং বুদ্ধিজীবি হত্যার কাজে যুক্ত ছিল।

এসব বিবরণ অনুসারে পাকিস্তানী সৈন্যদের দ্বারা সব নির্যাতন হয় নি। বাঙালী সহযোগীদের এসব অপ্রাসংগিক বিবরণ- পাকিস্তানী সৈন্যরা যে নিজেদের সুবিধার জন্যই এদের উপস্থিতি ও সহযোগিতা তৈরী করেছিল- তা অস্বীকার করে। সব যুদ্ধেই প্রাতিষ্ঠানিক মিলিটারি যন্ত্রের অপরিহার্য পাদুকা-সৈন্য (foot-soldier) হিসেবে স্থানীয় কিছু সহযোগী কাজ করে- এখানে এই বিশ্লেষণী পয়েন্টটিকে উপেক্ষা করা হয়েছে।

পাকিস্তানী সৈন্যদের দেখানো হয়েছে দয়ালু, কিন্তু শুধু আক্রান্ত হলেই এরা হিংস্র হয়; অপরদিকে বাঙালীরা ‘কোন কারণ ছাড়াই’ হিংস্রতা করে। একাত্তর সালে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বোঝাতে এ ধরণের কিছু প্রবাদ ব্যবহার করা হয়েছেঃ “মার্চে বিস্তৃত বিশৃংখলা”, “আইন অমান্য করতে উসাহী”, “নগর সন্ত্রাস” এবং “বিদ্রোহী”। পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রতি ব্যবহারকে উল্লেখ করা হয়েছেঃ “বাঙালীরা তাদের কাছে খাদ্য ও জ্বালানী বিক্রয় করতে অস্বীকৃতি জানায়...এবং গণহারে কারফিউ অমান্য করে, সেনাসদস্যকে নিহত করে,”- এগুলো কোন প্রতিরোধ ও বিরোধিতার উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয় নি, বরং পাকিস্তানী সৈন্যদের ভোগান্তি এবং ‘উস্কানির মুখে সেনাবাহিনীর অসাধারণ ধৈর্য্য’ প্রদর্শনীর উদাহরণ হিসেবে এগুলো তুলে ধরা হয়েছে।

“আইনের শাসন” পাকিস্তানী সেনাদের সাথেই ছিল যেহেতু তারা ভূ-খন্ডের “নিরাপত্তা” ও “নিয়ন্ত্রণ” প্রতিষ্ঠায় রত ছিল। সৈন্য প্রতিক্রিয়াকে দেখানো হয়েছে “আচ্ছন্ন বা অভিভূত”, অপরদিকে বিদ্রোহীরা ছিল “অসংগঠিত এবং অপেশাদার” যারা “কোন কারণ ছাড়াই...বাজারে আগুয়ান বাহিনীর প্রতি গুলি ছুঁড়েছিল যার ফলে সেনারা তাতে আচ্ছন্ন হয়ে প্রতিক্রিয়া ঘটায়”।

একাত্তরের বর্ণনা সম্পর্কে যে বিবিধ বিতর্ক বাংলাদেশে প্রচলিত আছে তার কোন বিবরণ এখানে নেই। ফলে, মুক্তিযোদ্ধা ইকবালের দৃষ্টিতেঃ “পৃথিবীতে এটাই বোধহয় একমাত্র দেশ, যার স্বাধীনতা নিয়ে দু’টো ভিন্ন মত রয়েছে”- এ কথার কোন বিশ্লেষণ এখানে পাওয়া যায় না। যুদ্ধ এবং হিংস্রতা নিয়ে বিভিন্ন সুগভীর যে পাঠ্য রয়েছে (বুটালিয়া, ১৯৯৮; দাশ ১৯৯৫; নর্ডস্ট্রম ২০০৪) তা দেখায় যে দেশে দেশে স্বাধীনতার বর্ণনা সব জায়গায় একই রকম নয় এবং যে যুদ্ধের ফলে কোন দেশ স্বাধীন হয় তা নিয়ে নানাবিধ বিতর্ক ও প্রশ্ন থাকে। দেশ বিভক্তি এবং স্বাধীনতার ক্ষত-বিক্ষত ইতিহাস নিয়ে বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।

এছাড়া, নিক্সনের বাংলাদেশকে “ঈশ্বর-নিন্দিত স্থান” হিসেবে উল্লেখ করা সম্পর্কে কোন মন্তব্য করা হয় নি। এই নিবন্ধটি, যা যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র বিভাগ আয়োজিত একটি সম্মেলনে প্রথম উপস্থাপন করা হয়- সেখানে বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের ভূমিকায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন সম্পর্কে (ঠান্ডা যুদ্ধ সমীকরণ প্রসংগে) কোনরূপ আলোচনার অনুপস্থিতি বিশেষ করে চোখে লাগে।

এই নিবন্ধটি সৈন্যদের জাতীয়তাকে “পাঞ্জাবী” হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্য থেকে কিছু ভিন্নতা বের করে আনতে আমাদের সাহায্য করে। যুদ্ধকালীন সময়ে যে একই মানুষের মধ্যে হিংস্রতা, দয়ালুতা, কাপুরুষতা, দুষ্কর্মে সহযোগিতা, স্ববিরোধীতা ইত্যাদি সবকিছুর সমাবেশ হতে পারে- তা নতুন কিছু নয় এবং বিভিন্ন নারীবাদী, গবেষক, এবং ছবি নির্মাতারা তা আমাদের দেখিয়েছেন (আখতার এট আল, ২০০১, চৌধুরী ২০০১, কবীর ২০০৩, মাসুদ ১৯৯৯, ২০০০)।

তারা বাংলাদেশের যুদ্ধ নিয়ে নানাবিধ, স্ববিরোধী, আত্মমাত্রিকতা এবং নারী, বিহারী এবং আদিবাসীদের উপর নির্যাতন দেখিয়েছেন। আমার নিজের কাজেও আমি একই ধরণের বিষয়ের সমমুখীন হয়েছি। এসব উদাহরণকে অ-ঐতিহাসিক এবং অ-রাজনৈতিক “তথ্য” হিসেবে উপস্থাপন করার চাইতে, স্থানীয় এবং জাতীয় রাজনীতি ও ইতিহাসের সংযোগস্থলে এদের স্থান নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

কলিংউডের যে সূত্র আগে উল্লেখ করেছিলাম তা এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বোসের অন্য লেখাগুলোতে তিনি ইন্দো-পাকিস্তানী দ্বন্দ্বের উর্দ্ধে উঠতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি পতাকার বিভিন্ন প্রতীকি ভূমিকা এবং ভারতে একটি পাকিস্তানী পতাকা রাখার সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে তা তুলে ধরেছিলেন (২০০৩)। ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরে (বোস এবং মাইলাম, ২০০৫) তিনি পাকিস্তানের কাছে এফ-১৬ বিমান বিক্রির সমর্থনে লিখেছিলেন যে এটা পৃথিবী এবং উপমহাদেশীয় ভূ-রাজনীতির জন্য স্থিতিশীল নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু EPW নিবন্ধে, তার বর্ণনাশৈলীর প্রকৃতি এবং ‘তথ্য’ উপস্থাপন তাঁর “কেইস”গুলিকে বাংলাদেশের সবার যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা হিসেবে তৈরী করেছে।

 

ধর্ষণের ইতিহাস বিকৃতি

বোসের নিবন্ধের শেষ পৃষ্ঠায় ক্ষুদ্র একটি প্যারাগ্রাফে পাকিস্তানী সৈন্যরা যে ধর্ষণ করে নি তার সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে তিনি তাঁর “কেসগুলিতে” ধর্ষণের অনুপস্থিতির ব্যাপারটিকে গুরুত্বসহকারে তুলে ধরেছেন। উত্তরসূরীর প্রতি জবাবে বোস বলেন- “১৯৭১-এ নিপীড়নের বিভিন্ন নমুনা বিষয়ে ৬,৫০০ শব্দের এ নিবন্ধটিতে ধর্ষণ বিষয়ে মাত্র ১০০-এর কাছাকাছি শব্দ রয়েছে”। ধর্ষণের মত একটি বিতর্কিত বিষয়কে নিপীড়নের কোন “নমুনা” হিসেবে অনুপস্থিত দেখানো হয়েছে, তাও মাত্র ১০০ শব্দ খরচ করে! বোস ব্যাখা করেন- “পরবর্তী আলোচনায় আমি উল্লেখ করেছি- ১৯৭১-এ যে ধর্ষণ নিশ্চিতভাবে হয়েছে তার প্রমাণ অন্যত্র আছে। কিন্তু আমার এ গবেষণা এবং অন্যান্য কাজ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়- ধর্ষণের যেসব ঘটনা ঘটেছে বলে দাবী করা হচ্ছে, সবক্ষেত্রে হয়ত তা ঘটে নি”।

বোস যে মন্তব্য করেছেন “১৯৭১-এ ধর্ষণ অন্যত্র সংঘটিত হয়েছে”- সেটা তার EPW নিবন্ধে নেই। সেখানে তিনি কোন ঘটনাগুলোয় ধর্ষণ হয়েছে এবং কোনগুলোতে হয় নি তা পৃথক করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। আগাগোড়া এখানে দেখানো হয়েছে বাঙালীরা বিহারিদের ধর্ষণ করেছিল কিন্তু পাকিস্তানী সেনারা যুদ্ধের সময় কাউকে ধর্ষণ করে নি। এছাড়া, “ধর্ষণের যেসব ঘটনা ঘটেছে বলে দাবী করা হচ্ছে, সবক্ষেত্রে হয়ত তা ঘটে নি”- এই বক্তব্যের সমর্থনে আসলে কোন ‘কেসগুলোর’ কথা বলা হয়েছে সেটাও স্পষ্ট নয়। এ ধরণের সরলীকৃত বক্তব্য না দিয়ে তিনি যে নির্দিষ্ট “কেসগুলোয়” ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে কিন্তু গবেষণায় পাওয়া যায় নি- তা উল্লেখ করলে বরং এটি বেশি স্বচ্ছ গবেষণা হত।

বোস দেখিয়েছেন, “দুর্বৃত্তরা” যে “বিদ্রোহ” করেছিল সেখানে “নারী অপহরণ ও নিপীড়ন” করা হয়েছিল। অপরদিকে, পাকিস্তানী সেনারা “সবসময়” নারী ও শিশুদের বাদ দিয়ে শুধুমাত্র পূর্ণবয়স্ক পুরুষদেরকেই টার্গেট করেছিল। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হামুদুর রহমান কমিশনও (২০০০) বাঙালীদের দ্বারা প্রো-পাকিস্তানী এলিমেন্টের ওপর আক্রমণ ও ধর্ষণের উল্লেখের সময় ধর্ষণের বিভিন্ন ঘটনাও উল্লেখ করেছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ সম্বলিত আট খন্ডের দলিল (রহমান ১৯৮২-৮৫: ১০৬, ১৯২, ৩৮৫), সত্তর দশকের বিভিন্ন বই (গ্রীয়ার ১৯৭২; ব্রাউনমিলার ১৯৭৫) এবং সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণা ও সিনেমা যেগুলো বাংলাদেশের মধ্যে মৌখিক ইতিহাসের ভিত্তিতে তৈরী হয়েছে (আখতার ২০০১; চৌধুরী ২০০১; গুহঠাকুরতা ১৯৯৬; ইব্রাহিম ১৯৯৪, ১৯৯৫; কবির ২০০৩; মাসুদ ২০০০) সেগুলোতে দেখা যায় যে পাকিস্তানী সৈন্যরা ধর্ষণ করেছিল এবং তাদের এসব নৃশংসতা ও এর জটিলতাগুলোর বিবরণ খুব ভালোভাবেই এগুলোতে তুলে ধরা হয়েছে। বোস তার নিবন্ধে এর কোন একটি থেকেও কোন তথ্যসূত্র ব্যবহার বা উল্লেখ করেন নি।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে অনেক নারী যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সৈন্য এবং স্থানীয় সহযোগীদের দ্বারা তাদের ধর্ষণকালীন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়েছেন। জনপ্রিয় ভাস্কর, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী তার যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা এবং যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্য ও বাঙালীদের ভূমিকা সম্বন্ধে সরব আছেন। যুদ্ধের সময় ধর্ষিত হয়েছেন এরকম বিভিন্ন মহিলাদের সাথে কাজ করতে গিয়ে আমি তাদের উপর সংঘটিত নৃশংস ঘটনার বিবরণে যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পেয়েছি। এসব বিবরণ যুদ্ধ সম্পর্কে যেসব বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ধারণা বর্তমানে প্রচলিত তার বিরূদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে উদ্ভূত হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধকালীন এসব স্ববিরোধী বিবরণকে গুরুত্ব দেয়া আর পাকিস্তানী সৈন্য এবং তাদের স্থানীয় দোসরদের দ্বারা সংঘটিত ধর্ষণের ঘটনাগুলো অস্বীকার করা সদৃশ নয়।

পুনর্মিত্রতার একটি ব্যবস্থাপত্র?

বোসের মতে, যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ দ্বারা নিপীড়ন হয়েছে- এরকম একটি স্বীকার্যের মাধ্যমে সব পক্ষের মধ্যে পুনর্মিত্রতা হতে পারে। বলাই বাহুল্য, বোসের এই বক্তব্যের ভিত্তি হচ্ছে পরোক্ষ সূত্র হতে প্রাপ্ত (শুধু মাত্র জেনারেল নিয়াজীর সাথে একটি সাক্ষাতকারের কথা খুব সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে) বিভিন্ন পাকিস্তানী সেনা এবং প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থনের মাধ্যমে এর প্রতি অনায্য আস্থাজ্ঞাপন।

১৯৭১ নিয়ে যে অসংখ্য প্রকাশনা রয়েছে বোস সেগুলোকে একটি “কুটির শিল্পের” সাথে তুলনা করার পাশাপাশি বাঙালীদের অনুভূতিগুলোকে অস্বীকার করতে চেয়েছেন “অস্বাস্থ্যকর বলি সংস্কৃতির চাষাবাদ” এবং “আন্তর্জাতিক মনোযোগ আদায়ে ষাট লক্ষ ইহুদীর সাথে দানবিক প্রতিযোগিতা” ইত্যাদি উক্তির মাধ্যমে। তার এসব উক্তি যাদের নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন তাদের প্রতি উদাসিনতা এবং নিপীড়ন সম্পর্কে তাদের যে উপলব্ধি রয়েছে তার প্রতি সংবেদনহীনতাকেই নির্দেশ করে।

আউশভিতজের ওপর প্রিমো লেভির কাজে দেখা যায় যে যারা নিপীড়িত হয়েছে এবং যারা নিপীড়ন থেকে রক্ষা পেয়েছে তারা যার যার দৃষ্টিকোণ থেকে নানা জটিল, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং পরস্পরবিরোধী বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে তাদের বেঁচে যাওয়া এবং “নিপীড়িত” অবস্থাকে তুলে ধরে। এখানে, বাংলাদেশী বিবরণগুলো উল্টো যুদ্ধকালীন বর্ণনাগুলোকে অস্বীকার করার হাতিয়ার।

“পুনর্মিত্রতার” এই ব্যবস্থাপত্র প্রত্যক্ষদর্শীদের এই বিবরণগুলোকে প্রকারান্তরে গলা টিপে ধরবে। আরো গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার হচ্ছে, অধিকাংশ বাংলাদেশীর কাছে “পুনর্মিত্রতা” শব্দটি কর্কশ অনুরণন তোলে কারণ একাত্তরে যারা পাকবাহিনীর যুদ্ধ-কালীন সহচর ছিল- যারা বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবার পুনর্বাসিত হচ্ছে- এই “পুনর্মিত্রতা” তাদের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে ধরা হয়।

নিক্সন যাকে বলেছেন “ঈশ্বর-পরিত্যক্ত স্থান” এবং কিসিঞ্জার “তলাবিহীন ঝুড়ি”- সেই বাংলাদেশ গতানুগতিকভাবে আন্তর্জাতিক বিশ্বে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় পরিচিত শুধু তার দারিদ্র, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হবার কারণে, তাই এর প্রয়োজন হয় ত্রাতার, বাইরের হস্তক্ষেপকারীর, উন্নয়নের বিভিন্ন নমুনার।

এখানে, বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতি আবার অযৌক্তিক হয়ে পড়ে উপমহাদেশীয় চালিকাশক্তির কাছে, যেন এখানে বাংলাদেশের বৃহত্তর চিত্রের সাথে কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।

এই নিবন্ধের বর্ণনাশৈলীই প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের পুনর্মিত্রতার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং এসব দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলার জন্য কোন ব্যবস্থা দিতে পারে নি। পাকিস্তানী সৈন্য এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীদের দ্বারা বাংলাদেশের যুদ্ধে যে ধর্ষণের ইতিহাস রয়েছে এই মৌলিক নিপীড়নকে অস্বীকার না করে যুদ্ধ-কালীন স্ববিরোধিতা, সংযুক্ততা, বিভক্তিকে তুলে ধরা যেতে পারে।

বাংলাদেশের যুদ্ধ কারো কাছে “গৃহ যুদ্ধ” হতে পারে, অথবা ভারত ও পাকিস্তানের কাছে কেবল একটি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ; কিন্তু অধিকাংশ বাংলাদেশীর কাছে এটি তাদের মুক্তি ও স্বাধীনতার যুদ্ধ, এমনকি ঔপনিবেশিক-উত্তর বাংলাদেশে সে স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও। ইন্দো-পাক ভূ-রাজনৈতিক ইস্যুতে ইন্ধন যোগানোর চেষ্টায় অহেতুক বিতর্ক না করে শুধুমাত্র বাংলাদেশ-কেন্দ্রিক ইস্যুগুলো এবং সেই সাথে যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতায় যেসব স্ববিরোধিতা রয়েছে তা তুলে ধরার মাধ্যমেই কেবল পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের পুনর্মিত্রতায় কেউ সাহায্য করতে পারে।


(ডেইলি স্টারের ফিচার পাতা ফোরাম থেকে সংগৃহীত ও অনুদিত। তথ্যসূত্রের জন্য লিংক থেকে মূল নিবন্ধ দেখুন। তানভীরের করা অনুবাদটি সচলায়তনে প্রকাশিত হয়েছে। লেখকের অনুমতিক্রমে মুক্তমনায় প্রকাশিত হল এবং মুক্তান্বেষার জন্য নির্বাচিত। )

ডঃ তানভীর ইসলাম - নগর পরিকল্পনাবিদ ও গবেষক। যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত।