প্রসঙ্গ সমকামিতা
প্রদীপ দেব
ডক্টর অভিজিৎ রায়ের লেখা মানেই বিশেষ কোন কিছু। ইংরেজিতে বললে আরো পরিষ্কার করে বলা যায় - সামথিং স্পেশাল। তাঁর “আলো হতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী” আমাকে টেনে এনেছে মুক্তমনার পাতায়। তখন থেকেই আছি মুক্তমনায় - এবং আরো অনেক চমৎকার সব লেখার মাঝে বিশেষ করেই খুঁজে পাই ডঃ অভিজিৎ রায়কে।
সমকামিতা প্রসঙ্গে তাঁর সাম্প্রতিক ধারাবাহিক “সমকামিতা (সমপ্রেম) কি প্রকৃতি বিরুদ্ধ?” লেখাটির দুটো পর্ব প্রকাশিত হয়েছে এ পর্যন্ত। শুরু থেকেই লেখাটি পাঠকের মনযোগ আকর্ষণ করছে। কোন লেখা শেষ হবার আগে সে সম্পর্কে মত প্রকাশ না করার একটা রীতি প্রচলিত আছে - তবে সেটা হলো ফর্মাল ব্যাপার এবং গল্প উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বৈজ্ঞানিক বিষয়ে লেখকের সাথে পাঠকের সমন্বয় যত বেশি হয় ততই ভালো। কারণ বিজ্ঞানভিত্তিক লেখার ক্ষেত্রে যে সমস্যাটি সবচেয়ে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় তা হলো লেখাকে পাঠকের বোধগম্য করে তোলা। লেখক-পাঠকের সমন্বয়ের সুযোগ তাই ধারাবাহিক লেখাগুলোতে বেশি ঘটে। আমি সে সুযোগটা নিচ্ছি এখানে।
সামাজিকভাবে আমরা যখন কোনকিছু গ্রহণ বা বর্জন করি - তাতে প্রকৃতির দোহাই দিয়ে আমরা যা করি সবই কিন্তু মানুষ প্রজাতির ভাবনা চিন্তার প্রতিফলন। প্রকৃতি বলতে সেখানে হোমো সেপিয়ান প্রজাতির বাইরে যে বিশাল প্রাকৃতিক প্রজাতির সমাহার - তাকে হিসেবে রাখিনা। তাই সমাজে সমকামিদের গ্রহণযোগ্যতা আছে কিনা বা থাকবে কিনা কিংবা থাকলেও কী পর্যায়ে থাকবে তা পুরোটাই সামাজিক। এ সামাজিক সিদ্ধান্তটি ভালো কি খারাপ তা প্রশ্নসাপেক্ষ - তবে সিদ্ধান্তটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে নেয়া হয়নি। (সামাজিক সিদ্ধান্তের বেশির ভাগই বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে নেয়া হয়না - সেখানেই আমাদের সমাজের পশ্চাৎপদতা।)
প্রকৃতির বেশির ভাগ জীবের (উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব সবকিছু)মধ্যে যৌন বা অযৌন মিলন হয় বংশবিস্তারের উদ্দেশ্যে। মানবসমাজে নারীকে যে বংশবিস্তারের ভূমি বা শস্যক্ষেত্রের সাথে তুলনা করা হয়েছে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে - তাকেও সে হিসেবে প্রাকৃতিক সত্য বলে চালিয়ে দেয়া যায় - এবং তাই করা হচ্ছে এখনো। ডঃ অভিজিত রায় প্রবন্ধের ভূমিকাতেই তা উল্লেখ করেছেন। সেখানে আমরা যাকে “প্রেম” বলি তা নেই। আছে “কাম”। কাম ও প্রেমের পার্থক্য ও সীমারেখা নিয়ে গাদাগাদা লেখা হয়েছে আরো হচ্ছে এবং হবে। লেখক নিজেও এব্যাপারে বলেছেন। তবে বর্তমান প্রবন্ধে যেহেতু সামজিক অবস্থানের চেয়েও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিটা প্রতিষ্ঠা করাটা মুখ্য - তাই আমি মনে করি সমকামিতাকে সমপ্রেম বললে কিছুটা লক্ষ্যচ্যুতি ঘটে।
কথাসাহিত্যিক শংকরের “সোনার সংসার” উপন্যাসে একটি ঘটনার উল্লেখ আছে যেখানে আমেরিকান মেয়েটি কলকাতায় বেড়াতে এসে জোড়ায় জোড়ায় ছেলেদের প্রকাশ্যে হাতধরাধরি করে গলাজড়িয়ে ধরে হাঁটতে দেখে ভেবেছে তারা সমকামী। আবার পশ্চিমে এখন যে সমকামীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা চলছে - তাতে দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগই অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে। যেমন আয়কর প্রদান বা সোশাল সিকিউরিটি বেনিফিটের ক্ষেত্রে যুগলরা একাকীদের চেয়ে ভালো সুবিধা পায়। সে যাই হোক সামাজিক ইস্যু এ প্রবন্ধে আসবে শেষের দিকে - এরকমই বলেছেন লেখক। তখন নিশ্চয় এর বিস্তারিত আলোচনা হবে।
প্রকৃতির নানারকম জীবের মধ্যে বংশবিস্তারের যে হাজারো রকমের ভিন্নতা আছে - তা সত্যিই অবাক হবার মতো। যেমন এই যে আমাদের পরিচিত কেঁচো - উভয়লিঙ্গ। নিজের শরীরের ভেতর স্ত্রী পুরুষ উভয় ধরণের জননঅঙ্গ ধারণ করে আছে। কিন্তু নিজে নিজে বংশবিস্তার করতে পারে না, বংশবিস্তারের জন্য আরেকটি কেঁচোর সাথে মিলনের দরকার হয়। ডঃ রায়কে ধন্যবাদ চমৎকার সব বৈজ্ঞানিক তথ্যের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য।
মানুষের মধ্যে সমকামিতার ব্যাপারে একটি উল্লেখযোগ্য বই আমি দেখেছিলাম বেশ কয়েকবছর আগে। বইটির
details:
Title: A Seperate Creation: How Biology Makes Us Gay.
Author: Chandler Burr
Publisher: Bantam Books, Transworld Publishers Ltd, London, 1996.
বইটি অভিজিতের গ্রন্থতালিকায় আছে আশা করি। ডঃ অভিজিৎ রায় ও মুক্তমনাকে অভিনন্দন।
ডিসেম্বর ২০০৭
লনচেস্টন, অস্ট্রেলিয়া।
ডঃ প্রদীপ দেব। মেডিকেল ফিজিক্সের লেকচারার। স্কুল অব হিউম্যান লাইফ সায়েন্সেস, ইউনিভার্সিটি অব তাসমানিয়া, অস্ট্রেলিয়া।