কবি জাহেদা খানমের কবিতায় নারী
ঋগবেগ থেকে পাঠ করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক নারায়ন বিশ্বাস। ৫১/এ ধানমণ্ডির বাড়িতে। ৩১ মার্চ সন্ধ্যা ৭ টায়। কবি জাহেদা খানমের কুলখানিতে। হ্যাঁ, কোরাণ শরীফ থেকেও পাঠ হয়েছে। হয়েছে স্মৃতিচারণ। একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে যেখানে সংস্কৃতির গভীরে ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রোথিত, কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত ধর্মীয় পরিচয় প্রাধান্য পায়, রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড কোরাণ থেকে পাঠ ব্যতীত শুরু হয় না, সংবিধান পর্যন্ত ধর্মীয় ছোঁয়া থেকে মুক্ত নয়, সেখানে পঁচাশি বছর বয়সে মৃত্যুবরণকারী এক নারীর কুলখানিতে কীভাবে উপস্থিত হয়ে অন্য ধর্মের লোককে স্বাধীনতা দেওয়া হয় তাদের প্রিয় ব্যক্তিকে তাদের মত করে শ্রদ্ধা জানাবার, স্মৃতিচারণ করবার ?
সম্ভব এবং সম্ভব মরহুমার নিজের জীবন দর্শনের প্রভাবে। আমরা তাঁর বাড়িতে বকুল গাছের নীচে নামাজে জানাযায়ও দাঁড়িয়েছিলাম ২৮ মার্চ তাঁর বড় মেয়ে শিরীন হকের আহ্বানে। আমি আমার মত করে মনে মনে বাংলা বাক্যে তার আত্মার শান্তি প্রার্থনা করেছি।
আমাদের দেশে যেখানে যে কারও মৃত্যুর পর হিন্দু হলে গীতা পাঠ আর মুসলিম হলে কোরাণ শরীফ থেকে অনর্গল পাঠ চলে সেখানে মরহুমার লাশের পাশে বসে রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী তামান্না খান পপি শুনিয়েছেন মরহুমার প্রিয় রজনীকান্ত সেনের “তুমি নির্মল কর, মঙ্গল কর মলিন মর্ম মুছায়ে” গানটিসহ আরও কয়টি রবীন্দ্র সংগীত।
এরও বছর দু‘ আগে মরহুমা তাঁর অকাল প্রয়াত কন্যা নাসরীন হকের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান কোন বিশেষ ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ রাখেননি। কোথায় পেয়েছিলেন তিনি এত মানসিক শক্তি ! এমন মহান মন্ত্র !
সেই মন্ত্রের সন্ধান ২০০৮ এর বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর দু‘টি কাব্যগ্রন্থ ‘ধলপ্রহরের স্মৃতি’ আর ‘জীবন তরী’ পর্যালোচনা করলে কিছুটা পাওয়া যাবে। কারন শুধু বইয়ের পাতায় এমন প্রাণের সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায় না, তা খুঁজতে হবে তাঁর প্রাত্যহিক জীবনাচারে। সে উদ্যোগ নিশ্চয়ই কেউ না কেউ নেবেন।
কবি জাহেদা খানম ছিলেন আলোর পথের অভিযাত্রী। যে আলো বিচ্ছূরিত হয় এবং যা তিনি আজীবন খুঁজেছেন তা হল-----
‘সত্য সুন্দর ন্যায়-নীতির জন্য
সাম্য মৈত্রী শান্তির জন্য-----
আমরা নেমেছি পথে
ঋদ্ধ জীবনের সন্ধানে।’
(জীবন তরী / অভিযাত্রী)
তিনি বুদ্ধের অহিংস দর্শনকে অন্তরে ধারণ ও লালন করতেন। তাইতো বলতে পেরেছেন---
‘হিংসা ছাড়ো ভালোবাসো প্রাণ
শান্তি পাবে, পাবে পরিত্রাণ।’
(জীবন তরী / বুদ্ধ)
আমি শুধু কবি জাহেদা খানমের নারী বিষয়ক কিছু কবিতা নিয়েই আমার আজকের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো। তিনি ব্যক্তি জীবনে নারী মুক্তি আন্দোলনে ছিলেন একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। তাঁর নারী বিষয়ক মননশীল ভাবনার বহিঃপ্রকাশ রয়েছে তাঁর কবিতায়ও।
সেদিন ছিল ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ১৯৯১ সালে ৪৭টি সংগঠন একত্রিত হয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন কমিটির মাধ্যমে এ দিবসটি পালন করে। সে বছরে ৮ মার্চ ছিল আশা আকাক্সক্ষায় ভরপুর। বাংলাদেশে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী সরকার পরিচালনা করছে। জাহেদা খানমের কলমেও সেই প্রেক্ষাপটে বেজে উঠে----
‘ভেঙেছে আজ ঘরের আড়াল
খুলেছে আজ পায়ের বেড়ি
আঁধার ঘরের বন্ধ কারায়
থাকবে না আর নারী।
-------------------
-------------------
ভয় ভেঙেছে
চোখ খুলেছে
উঠছে জেগে নারী
জগৎ জুড়ে এবার তাদের
বাজবে জয়ভেরি।’
(জীবন তরী / উঠছে জেগে নারী)
১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে অংশগ্রহনকারী জাহেদা খানমের প্রাণের আবেগ উছলে উঠার শব্দ শুনি---
‘মুক্ত মনের অঙ্গনে আজ
মুক্ত আলোর চমকানি,
মুক্ত হওয়ার আনাগোনা
মুক্ত হাসির ঝলকানি।’
--------------------
--------------------
দূর দিগন্তে দেশে দেশে
সবার সুখে সবার দুখে
থাকব সবাই সবার পাশে’
(জীবন তরী / মুক্ত আলো)
নারী অধিকার আন্দোলনের সাথে একা হয়ে তিনি আজীবন আশেপাশের সবার সুখে-দুখে পাশেই থেকেছেন। নারী ও পুরুষ উভয়ের অবদানেই সভ্যতার সৃষ্টি। উভয়ের দায়িত্ব কুসং¯কারকে দূর করার জন্য সর্বত্র জ্ঞানের মশাল বয়ে নিয়ে যাওয়া। তাই তাঁর আহ্বান--------
‘নারী ও নরে সবাই মিলে
প্রতি ঘরে জ্বালো
সেই আলোকে দূর করে দাও
অন্ধ মনের কালো।’
(জীবন তরী / জ্ঞানের প্রদীপ)
চলমান ঘটনায় তাঁর হৃদয়ের যে রক্তক্ষরণ, তিনি যে আলোড়িত হতেন, এরই প্রতিফলন অজানা গৃহকর্মী আমেনার আত্মহত্যা নিয়ে লেখা কবিতায়। নারী মুক্তির জন্য যার হৃদয় উদ্বেলিত তাঁর কবিতার বিষয় নির্বাচনে স্বতঃসিদ্ধভাবেই কমলগঞ্জের নূরজাহান থেকে রাজস্থানের রূপ কানওয়ার স্থান পেয়েছে।
ধর্মের নামে নারীর উপর সব দেশে সবকালে চলে জুলুম আর অত্যাচার। কবি তাই প্রতিবাদী কণ্ঠে বলেন-----
‘হেথা ধর্মের নামে চলে অধর্ম
শাস্ত্রের নামে মিথ্যা বলে
করে প্রতারণা ভন্ডের দলে
ভক্তির ছলে।’
(ধলপহরের স্মৃতি / রাজস্থানের রূপ কানওয়ার)
সারা বিশ্বের নারীদের অবস্থা ও অবস্থান নিয়েই তাঁর চিন্তা চেতনা আবর্তিত হত। তাই তো ইংল্যান্ডের ‘ডাইনি’ আখ্যায়িত মা তাকে মেরে ফেলার আগে মেয়েকে যে চিঠি লিখেছিল এরও ভাবানুবাদ স্থান পায় তাঁর কবিতায়।
নারীপক্ষ‘র জন্ম যার বাসভবনে সেই সংগঠনের মেয়েদের উদ্দেশ্যে তাঁর ‘নারী’ কবিতাটিতে রয়েছে বিশ্বব্যাপী নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক, পৌরানিক ও আন্দোলনের ইতিহাস। রয়েছে আন্দোলিত হবার, সবল হবার আহ্বান---------
‘নারী, কতকাল আর রবে দুর্বল ?
তুমিও তো মানুষ
আর সব মানুষের মত,
আছে দেহে প্রাণ,
প্রাণ ভরা আছে গান,
বুকভরা রঙিন স্বপন।
অনুভব উপলব্ধি
নাই কিছু কম।
আছে তোমার মস্তিষ্ক সবল
তবু কেন রহিবে দুর্বল।’
(জীবন তরী / নারী)
জাহেদা খানমের কবিতায় সাহিত্য রসের সাথে যুক্ত হয়েছে নারী আন্দোলনের চেতনা। তাই অনেক সময় নারী বিষয়ক কবিতায় আবেগের চেয়ে নারী মুক্তির মূলমন্ত্র উচ্চারিত। তিনি উৎকণ্ঠিত নারীর অবস্থা ও অবস্থানের ইতিবাচক পরর্বিতনের জন্য। তাই তার কবিতার আবদেন বুঝতে হৃদয় ও মস্তিষ্ক দুই-ই খাটাতে হয়।
মণিপুরীপাড়া
ঢাকা- ১২১৫