অন্তর্ঘাত
(রাজনৈতিক উপন্যাস)
আবুল হোসেন খোকন
[ সত্তর দশক বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সামরিক শাসনের পটভূমিকে ভিত্তি করে এই রাজনৈতিক উপন্যাসটির অবতারণা। অপ্রকাশিত এ পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ ধারাবাহিকভাবে মুক্তমনায় তুলে ধরা হলো। লেখক ]
পার্ট - ৩
সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিল মিতুল। ঠান্ডা, গাঢ় এক রকম মিষ্টি বাতাস। চারদিকে খোলা অবারিত সবুজ বনভূমির মাঝে একটা মাঠের মতো। ফাঁকা। বাতাসের দোলায় লতা-পাতা দুলছে। তারই মধ্যে মিতুল এবং একটা ছেলে। হাত ধরে হাঁটছে দু’জন। হিমেল বাতাস ওদের চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। ছেলেটিকে কোনদিন দেখেনি মিতুল। তবুও পরম বিশ্বাসে হাতে হাত রেখেছে। এতো ভাল লাগছে মিতুলের, যা কোনদিন হয়নি। মনে হচ্ছে ছেলেটা কোন রাজপুত্র, আর মিতুল রাজকন্যা। পৃথিবীতে ওরা দু’জন ছাড়া যেন আর কেও নেই। ওরা যেন অপ্রতিরোধ্য, দূরন্ত দুর্বার। দু’জন ইচ্ছে করলে বাতাসে উড়তে পারছে। ছোট ছোট গাছ-পালার ওপর দিয়ে ঠিক পাখির মতো ভাসতে পারছে। একটু লজ্জা লজ্জা করছে মিতুলের। তবু শক্ত করে হাত ধরে রেখেছে ও, যেন ছুটে না যায়। ছুটে গেলেই যেন সব হারিয়ে যাবে। এতো সুন্দর ঘটনা হারাতে চায় না। ছেলেটার মুখ ভাল করে দেখা হয়নি। একটা ছোট্ট টিলার পাশ দিয়ে যাবার সময় মুখের দিকে তাকালো মিতুল। ছেলেটি হাসলো। শিহরিত হলো মিতুল। মনে হলো কতো আপনার এই রাজপুত্র। এ রাজপুত্র শুধুমাত্র মিতুলে জন্যই।
হঠাৎ কি হতেই হাত ছুটে গেল। ভয় পেয়ে তাকাতেই দেখতে পেল, ছেলেটা পিছিয়ে যাচ্ছে। অদৃশ্য কোন শক্তির টানে যেন এগুতে পারছে না। ওকে ধরার জন্য দৌঁড়ানোর চেষ্টা করলো মিতুল। কিন্তু পা দুটো যেন অবশ হয়ে গেছে। কিছুতেই দৌঁড়াতে পারলো না। তারপর সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করলো। একটু নড়াতে পারলো। কিন্তু এগুতে পারছে না। পা এতো ভারী হলো কেন! ওদিকে রাজপুত্র ছেলেটি মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে! উঠে দাঁড়াচ্ছে টলতে টলতে। মিতুলের দিকে হাত বাড়ালো। এগিয়ে আসতে চাইলো। মিতুলও হাত বাড়ালো। এগিয়ে আসতে চাইলো। হাত বাড়িয়ে মিতুলও সামনে যেতে চাইলো। কিন্তু পারলো না। এবার যেন অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। প্রাণপণে মিতুল দৌঁড়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। দেখতে পেলো সামনে বিরাট একটা কূপ। রাজপুত্র না দেখে এগিয়ে আসছে। চিৎকার করতে চাইলো মিতুল। কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বেরুলো না। আতঙ্কিত চোখে শুধু দেখলো, ছেলেটি কূপের ভিতর পড়ে গেল। মিতুল দেখলো পানিতে ডুবে যাচ্ছে রাজপুত্র ছেলেটি। লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলো মিতুল। তখনই ঘুম ভেঙে গেল। হকচকিয়ে উঠে বসলো এবং খেয়াল করলো হাঁপাচ্ছে ও।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর গ্রামে এসেছে মিতুল। এটা ওর দাদুর বাড়ি। বেড়ানো শেষ হলে আবার শহরে ফিরতে হবে। তখন পরীক্ষার ফলাফলের জন্য টেনশনে থাকতে হবে। তারপর একদিন ফল বেরুবে। পাশও করবে ও। কারণ ভাল পরীক্ষা দিয়েছে। যাইহোক, সামনে নানান ঝামেলা। ভর্তি হওয়ার ঝামেলা, ভর্তির প্রস্তুতি নেয়ার ঝামেলা, আরও কতো কি। সুতরাং সব ঝামেলার আগে মনের আনন্দে নেচে-গেয়ে খোলা প্রান্তরে ঘুরে বেরানোর স্বাদটাকে পেতে চায় ও। তাই টুটুলকে নিয়ে চলে এসেছে দাদুর বাড়ি।
দাদুর বাড়িটা বিশাল। তাঁর পূর্ব পুরুষ জমিদার ছিলেন। এখনও তাই রয়ে গেছে বিশাল সম্পত্তি। আম, কাঠাল, লিচু, নারিকেল, তাল, খেজুরসহ হরেক রকম ফল-মূলের বাগানে ভর্তি বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে বাড়ি। এ বাড়িতে দাদু-দিদা আর এক চাচা ছাড়া কেও নেই। সুবিশাল এই বাগান বাড়ি অদ্ভুত ফাঁকা ফাঁকা। বাগানগুলো জোংলা গাছে পরিপূর্ণ। গাছে গাছে পাকা ফল থক থক করে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই বাগানের ভেতর দিয়ে যখন বেড়ানো হয়, তখন মনে হয় এটা কোন বন। কারণ গাছে গাছে কিচির মিচির করে পাখি। ডাকে ঘুঘু, কোকিল। বাগানে আরেকটা মজার জায়গা আছে বেশ দূরে, একেবারে শেষ প্রান্তে। এই জায়গাটা গেছো ফুলে ভর্তি। অনেক জাতের ফুলগাছের মধ্যে বকুল ফুল মিতুলে খুব প্রিয়। প্রতিদিন খুব ভোরে যখন শিশির ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ও আসে, তখন সাদা চাদরের মতো জমিনে ওপর ছড়িয়ে থাকা বকুল ফুলের মৌ মৌ গন্ধে প্রাণ ভড়ে যায়। ভেজা ভেজা ফুলগুলো দু’হাতে তুলে ডালি বোঝাই করতে অদ্ভুৎ মজা।
মিতুলের পাশের খাটে ঘুমিয়েছে টুটুল। মিতুল-টুটুল পিঠেপিঠি ভাই-বোন। তাই সব সময় ওদের খুনশুটি লেগেই থাকে। দাদুর বাড়িতে ওদের হয়েছে দারুণ মজা। সারাদিন হইচই আনন্দ-ফুর্তি। যে ঘরটাতে মিতুলরা রয়েছে, সেটা অনেক বড়। ওরা দু’জন ছাড়া আর কেও নেই এ ঘরে। পাশের একটি ঘরে দাদু আছেন এবং বিপরীত দিকের আরেকটি ঘরে চাচা-চাচী আর তাদের দুই পিচ্চি সন্তানেরা থাকে। এই গ্রামটা খুব ভাল। কোন চুরি-ডাকাতি নেই। তাই বিশাল জানালাগুলো খুলেই ঘুমিয়েছিল মিতুল আর টুটুল। জানালা দিয়ে হিমেল বাতাস ঢুকছে হু হু করে। জ্যোৎসনায় ভাসিয়ে রেখেছে ওদের খাট।
কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকার পর স্বপ্নের রেশটা কেটে গেল মিতুলের। বালিশের তলায় হাত ঢুকিয়ে ঘড়িটা বের করে আনলো। সাড়ে চারটা। তারমানে আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই ভোর হয়ে যাবে। আবার ঘুমুতে ইচ্ছে করছে না। এইটুকু সময় বরং বসেই কাটিয়ে দেয়া যাক। বসে বসে কল্পনা করতে বড্ড ভাল লাগে। তার ওপর জোয়ারের মতো বাতাস যেভাবে সব উড়িয়ে নিতে চাইছে, তাতে ভাল লাগার মাত্রাটা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। ঠান্ডা বাতাস মিতুলের চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে বারবার। হাঁটু গুটিয়ে থুঁতনী ঠেকালো ও। হাত দুটো জড়িয়ে থাকলো পা। এভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে জ্যোৎসনায় প্রকৃতি দেখতে থাকলো। জ্যোৎসনা মাঝে মাঝে হালকা মেঘের আবরণে ঢেকে যাচ্ছে। তখন আরও অদ্ভুৎ মনে হচ্ছে প্রকৃতিকে।
জ্যোৎসনার আবেশটা ক্রমেই থিতিয়ে আসতে লাগলো। ভোর হচ্ছে। গায়ের চাদরটা নামিয়ে খাট থেকে নামলো মিতুল। মেঝেয় খানিক পাঁয়চারি করলো। টুটুলটা এখনও ঘুমাচ্ছে। চাদর-টাদর ফেলে দিয়ে একেবারে এলোমেলো হয়ে আছে। ওর অভ্যাসটাই ওরকম। গুছিয়ে শুতে পারে না।
টুটুলের কাছে বসলো মিতুল। ভাল করে তাকালো ওর দিকে। খালি গায়ে লুঙ্গি পরে বেশ আয়েশ করে ঘুমুচ্ছে বেচারা। ডাকতে ইচ্ছে করছে না। অথচ ভোর হতে যাচ্ছে, বাইরে বের হতে হবে। শিশির ভেঁজা ঘাঁসের ওপর দিয়ে হাঁটতে হবে। যা স্বাস্থ্যের জন্য বড়ই উপকারী। অবশ্য মিতুল বা টুটুলের স্বাস্থ্য খারাপ নয়। বরং ওদের সুন্দর দৈহিক গরণ, বিশেষ করে অদ্ভুৎ সুন্দর চেহারা দেখে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও হতভম্ব হয়ে পড়বেন।
টুটুল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাসছে। মনে হয় স্বপ্ন দেখছে। মিতুল আস্তে করে টুটুলের বাহুতে হাত রাখলো। খুব নরম করে নাড়া দিলো। ঘুমন্ত মানুষকে কখনও জোরে করে ধাক্কা দিতে নেই। আদর করে ঘুম ভাঙাতে হয়। তাহলে নার্ভের স্বাভাবিকতা থাকে। এই দর্শন কোন এক অভিজ্ঞ মানুষের। এটাকে সাংঘাতিকভাবে মেনে চলে মিতুল।
টুটুলের বাহুতে মিতুলের স্পর্শ পড়তেই স্বপ্নিল হাসিটা নিভে গেল। একটু যেন কেঁপেও উঠলো। কিন্তু ঘুম ভাঙলো না। হাত বুলিয়ে আস্তে আস্তে নাড়া দিলো মিতুল। ডাকলো, ‘টুল, এই টুল। ওঠ।’ টুটুল কাঁৎ হয়ে ছিল। কোন শব্দ না করে চিৎ হলো। ‘টুল, এই টুল, ওঠ, উঠবি না?’ আবার ডাকলো মিতুল। কোন জবাব দিলো না ছেলেটা।
ওর বুকে হাত রাখলো মিতুল। বড় আদরের ভাই এটা। মিতুলের মনে হয় এটা ওর জান-প্রাণ। যখন ছোট ছিল, তখন একেবারে বুকে করে রাখতো ওকে। এই তো কিছুদিন আগেও মিতুল আর টুটুল এক বিছানায় ঘুমাতো।। কিন্তু ও এখন বড় হয়ে যাচ্ছে। তাই আলাদা হয়েছে। যখন আরও বড় হবে, তখন? তখন কি আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে দু’ ভাই-বোন? প্রকৃতির অদ্ভুৎ নিয়ম। ওটাই স্বাভাবিক। এই তো সেই ছোট্ট টুটুলের দেহে এখন ক্রমেই এক রকম রোশনাই দেখা দিয়েছে। পেশীগুলো মজবুত হচ্ছে। শরীরটা কী দারুণ আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। মুখে গোঁফের রেখাও ফুটছে। একদিন এমন হবে যখন টুটুল আর এ টুটুল থাকবে না। দাড়ি-গোঁফে পরিপূর্ণ এক যুবক হয়ে উঠবে। তখন কি মিতুলের পক্ষে ঘনিষ্ট হওয়া সম্ভব হবে? হবে না। মিতুলও আরও বড় হবে। তখন হয়তো টুটুলের চাইতে বেশি আকর্ষণ ঘটাবে কোন অপরিচিত যুবকের। সে-ই তখন মন-প্রাণ জুড়ে বসবে। একদিন ঘরও বাঁধবে। আজকের দু’ভাই-বোন কতো দূরে না চলে যাবে। টুটুলও বিয়ে করে সংসারী হবে। কতো পরিবর্তন ঘটবে। পরিবর্তনটাই স্বাভাবিক নিয়ম। যতো বড় হওয়া যায়, ততো পরিবর্তন ঘটে। যে বাবা-মা কতো আদর করে বড় করেছেন, তাঁরাও একদিন পর হয়ে যাবেন। টুটুলের মতো যে ভাই মিতুল ছাড়া কিছু বোঝে না, সেই টুটুলই একদিন এমন হবে যে নিজের স্বার্থটাকে বড় করে দেখবে। সম্পত্তির ভাগা-ভাগির প্রশ্ন যখন আসে, তখন এই জিনিসগুলোকে স্পষ্ট করে দেখা যায়। নাহ্, ভাবতে ভাল লাগছে না। হাত বুলাতে বুলাতে ডাকলো মিতুল, ‘অ্যাই টুটুল, টুটু, ওঠ্। ওঠ্ না আলসে ছোড়া কোথাকার।’
মিতুলের হাতটাকে বুকে চেপে ধরলো টুটুল। এক চোখ সামান্য ফাঁক করে বললো, ‘সকাল তো হয়নি। ডাকছিস কেন? ঘুমুতে দে।’ হ্যাঁচকা টান দিলো ও মিতুলের হাত ধরে। টুটুল বললো, ‘শুয়ে পড়তো এখানে, আয় শো।’ হাত ছাড়িয়ে নিলো মিতুল, ‘পাজি ছোঁড়া কোথাকার। ওঠ্।’ কাধে এক ধাক্কা দিলো মিতুল। দেড় ইঞ্চি লম্বা জিভ বের করে দেখালো টুটুল। তারপর বালিশ থেকে মাথা তুলে মিতুলের কোলের ওপর রাখলো এবং এক হাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরলো। বললো, ‘মাথায় হাত বুলিয়ে দে না লক্ষ্ণী বোন আমার। একটু ঘুমাই।
মিতুল আপত্তি করলো না। ওর মাথা ভর্তি নরম চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। টুটুল আয়েশে ঘুমিয়ে পড়লো। মনে মনে বললো মিতুল, ‘দাঁড়া, তোকে বিয়ে দিয়ে দেবো। তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার লোক হবে তখন।’ বিয়ের ব্যাপার নিয়ে দু’ভাই-বোনে মজার মজার তর্ক হয়। মিতুল যখন বলে, ‘শোন্রে টুটু, শিগগির তোর লাল টুকটুকে বউ আসবে। তোর বিয়ে হবে, হি হি।’ জবাবে টুটুল জিভ দেখিয়ে বলে, ‘ইস্ লাল টুকটুকে বউ! তুই যদি আমার বোন না হতি, তাহলে তোকেই বিয়ে করতাম। তোর মতো লাল টুকটুক সুন্দরী দুনিয়ায় আর আছে নাকি?’ এসব বলে টুটুল যখন চুকচুক করে আফসোস করে তখন মিতুল চোখ পাকিয়ে তাকায়। বলে, ‘অ্যাই পাজি ছোকড়া, খুব পাকামো শিখেছিস না? কান ছিঁড়ে দেবো।’ টুটুল তখন জিভ দেখিয়ে পালায়।
ভোরের ফর্সা ভাবটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। টুটুলের মাথাটা বালিশে নামিয়ে দিতে দিতে মিতুল বললো, ‘তোমার কি ওঠার ইচ্ছে আছে? উঠলে ওঠো, না হলে আমি চললাম।’ মিতুল রেগে গেলে টুটুলকে তুমি করে বলে। হঠাৎ টলতে টলতে উঠে বসলো টুটুল। গলা জড়িয়ে ধরলো মিতুলের। ঘাড়ের ওপর মাথা এলিয়ে দিলো। তারপর জড়িয়ে জড়িয়ে বললো, ‘ভালো লাগছে নারে আপু। ঘুব ঘুম পাচ্ছে।’ মিতুল গম্ভীর হয়ে রইলো। ব্যাপারটা ঘুমের ঘোরেও বুঝতে পারলো টুটুল। চোখ খুলে মিতুলের দিকে সোজাভাবে তাকালো। মিষ্টি করে হাসলো। দু’হাতে মিতুলের মাথাটাকে ধরে নিজের দিকে টেনে আনলো। তারপর চপাচপ তিন/চারটে চুমো খেয়ে বললো, ‘লক্ষ্ণী আপু আমার। আজকের মতো তুই একাই যা। আমার খুউব ঘুমুতে ইচ্ছে করছে। কাল ঠিক যাবো। তোর আগে আমি উঠবো। এই তোকে ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি।’ আরেকটি চুমু খেয়ে বললো টুটুল, ‘বল্ আপু, রাগ করিস্নি?’ হেসে ফেললো মিতুর। বললো, ‘ঠিক আছে তুই ঘুমো।’ ‘থ্যাঙ্কু মাই ডিয়ার আপু’ বলেই বালিশে এলিয়ে পড়লো টুটুল।
মিতুল বিছানা থেকে নামলো। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলো বেশ ফর্সা ফর্সা ভাব হয়ে এসেছে। আনন্দে নেচে উঠলো মন। বাইরে বেরুনোর জন্য প্রস্তুত হলো। স্কার্ট পড়ে নিলো ও। ওড়না-টোড়না দরকার আছে বলে মনে করলো না। ভোরের বাতাসে যতো কম পোশাকে বেড়ানো যায়, ততোই আরাম। স্যান্ডেলও নেবে না ও। কারণ স্যান্ডেল পায়ে বেরুলে শিশিরে ভেজা মাটি আর ঘাঁসের ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়ানোর আনন্দটাই শেষ হয়ে যাবে। জানালা দিয়ে বাইরেটা আরেকবার দেখে নিলো। তারপর বেরুনোর আগে খাটের কাছে দাঁড়ালো। ঘুমন্ত টুটুলকে ভাল করে দেখলো। ঝুকে দুটো চুমু খেলো। একটি কপালে, একটি ঠোঁটে। টুটুল জবাবে মিষ্টি করে হাসলো। মিতুল বললো, ‘থাক্ যাই।’
দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো ও। অন্ধকার ভাবটা থাকলেও আকাশ ফর্সা হয়ে উঠেছে। কখন যেন বাতাসটা পড়ে গেছে। তাই কুয়াশার আবরণ নেমে এসেছে। মিতুল স্কার্টের নিচের অংশটা খানিক উঁচু করে নরম নরম শিশির ভেজা ঘাঁসের মধ্যে নেমে এলো। কোন দিকে না তাকিয়ে ছুটলো বকুলতলার দিকে। বেশ দূর হাঁটতে হয়। তাই ঘাঁসের শিশিরে পায়ের দিকটা একাকার হয়ে গেল। ওই অবস্থায় ছড়িয়ে থাকা বকুল ফুলের আস্তরণের কাছে এসে থামলো।
একটু চমকে উঠলো। এই জায়গাটায় অন্য কারো আসার কথা নয়। এমনিতেই ফাঁকা জায়গা। বাগানের অন্যান্য দিকে কোন বাড়ি-ঘর নেই। শুধু ফসলের ক্ষেত। কিন্তু বকুলতলার মাটিতে কিছু যেন হেঁটে গেছে। বড় বড় জুতোর মতো অনেক দাগ। একেবারে গর্ত হয়ে বসে গেছে। দাগগুলো স্পষ্ট, যা এখনই হেঁটে যাবার প্রমাণ তুলে ধরছে। গর্তের ভেতরে সাদা সাদা বকুল ফুলের স্তুপ বসে গেছে। ভয় পেয়ে সামনের দিকে তাকালো মিতুল। চমকে উঠলো আবার। হতভম্বের মতো দেখলো অস্ত্র হাতে কালো কালো একদল মানুষ চলে যাচ্ছে। তাদের কাঠামোগুলো কুয়াশায় আবছা ভাবে দেখা গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘুড়ে দাঁড়ালো মিতুল। দৌঁড় দিলো বাড়ির দিকে।
কিন্তু পথ আগলে দাঁড়ালো ভয়ঙ্কর দর্শন এক মিলিটারি। হাতের মেশিনগান তাক করা মিতুলে বুক বরাবর। একজন নয়, কয়েকজন মিলিটারি ঘিরে ফেলেছে ওকে। মেশিনগান তাক করে রাখা মিলিটারিটি চাপা গলায় বললো, ‘বানচোৎ, এখানে কি হচ্ছে? দৌঁড়াচ্ছিলি কেন?’ স্তম্ভিত হয়ে গেল মিতুল। আতঙ্কে গলা দিয়ে স্বর বেরুলো না। পা দুটো হয়ে গেল পাথরের মতো শক্ত, আর ভারী। ঠিক স্বপ্নে দেখা সেই অবস্থার মতো। চেষ্টা করেও নড়তে পারলো না মিতুল। কোন শব্দও করতে পারলো না। মিলিটারিটা ধমকে উঠলো। কিন্তু মিতুল পাথর, হতভম্ব। টলছে ও, এখনই পড়ে যাবে। মিলিটারিরা নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করলো। ওদের দৃষ্টিতে চকচক করে উঠলো লালসা।
ঠিক তখনই সম্বিত ফিরে পেলো মিতুল। চিৎকার দেয়ার জন্য মুখ খুললো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কেও একজন মুখ চেপে ধরলো। অন্য কেও একজন হাতকাটা স্কার্টের ওপরের অংশ ধরে হ্যাঁচকা টান দিলো। একটানে জামাটা ছিঁড়ে দেহ থেকে চলে গেল। বেরিয়ে পড়লো নিরাভরণ দেহ। আরেকটা হ্যাঁচকা টান দিলো। ওকে ঠেলে নিলো পাশেই উপ্ড়ে কাঁত্ হয়ে পড়ে থাকা একটা বড় আম গাছের দিকে। ঠিক তখনই একজন ওর পরণের নিচের অংশটায় হ্যাঁচকা টান দিলো। ওটাও ছিঁড়ে মিলিটারির হাতে চলে গেল। ওকে চিৎ করে ফেলে দিলো আম গাছের গুড়িতে। কোন শব্দ করার সুযোগ পেলো না মিতুল। নড়াচড়াও করতে পারলো না।..................
মিতুল। খানিক আগেও মেয়েটির কাছে এই প্রকৃতি বড় সুন্দর ছিল। সুন্দর ছিল অরণ্যে ঘেরা বাগান, ঘাঁস, পাখি, শিশির, বকুল ফুল। বড় ভাল ছিল পৃথিবী আর সব মানুষ। ওর একটা স্বপ্নের জগৎ ছিল। প্রাণের চেয়েও প্রিয় একটা ভাই ছিল। ছিল বাবা-মা, আত্মীয় আর বন্ধু-বান্ধব। হয়তো ওর ভালবাসারও কেও ছিল। তাকে নিয়ে একটা স্বপ্ন ছিল, আশা ছিল। সুন্দর একটা ভবিষ্যতের কল্পনা ছিল। কিন্তু এক লহমায় সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। নিষ্ঠুর বাস্তবতা মিতুলের সবকিছু চুরমার করে দিলো।
---- চলবে ----
আবুল হোসেন খোকন : লেখক-সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।